- চাঁদ দেখাসাপেক্ষে আগামী বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রমজান শুরু হতে পারে। তার আগেই হবে নির্বাচন
- স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি-জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল
- নভেম্বরের শেষে কিংবা ডিসেম্বরের মধ্যে তপশিল ঘোষণা
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জাতির দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর শেষ হলো। গতকাল মঙ্গলবার রাতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানান, আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে রমজান শুরুর আগে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হবে। নির্বাচন যেন দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে সেজন্য সব আয়োজন সম্পন্ন করতে কাল (আজ বুধবার) থেকে প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। গতকাল রাত ৮টা ২০ মিনিটে জাতির উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে এই তথ্য জানান প্রধান উপদেষ্টা।
অবশ্য নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, নির্বাচনি কর্মযজ্ঞ তারা আগেই শুরু করেছেন। দীর্ঘদিন থেকেই দেশের মানুষ নির্বাচনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। প্রধান উপদেষ্টার এই নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার পর উৎফুল্ল সবাই। এই ঘোষণার মধ্য দিয়ে জাতির আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফল ঘটেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, প্রধান উপদেষ্টা একটি অবাধ-সুষ্ঠুু নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারলে জাতি তাকে শ্রদ্ধাভরে আজীবন স্মরণ করবে।
এদিকে প্রধান উপদেষ্টার গতকালের ভাষণের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক মহলে। নির্বাচনের সময়সীমা ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. শামছুল আলম সেলিম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে এক বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে একটা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই প্রতিশ্রুতি তিনি রক্ষা করছেন। জাতির উদ্দেশে তার এই ঘোষণায় মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফল ঘটেছে। এখন সুষ্ঠুু ও সুন্দরভাবে নির্বাচন সম্পন্ন করতে পারলে তার এই অবদান জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। জাতি তাকে সবসময় স্মরণ করবে। আমরা আশা করি, সবাইকে নিয়ে তিনি অবাধ-সুষ্ঠুুভাবে, উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচনটি সম্পন্ন করবেন।
চাঁদ দেখাসাপেক্ষে আগামী বছর ১৮ ফেব্রুয়ারি রমজান শুরু হতে পারে। এর আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে নভেম্বরের শেষে কিংবা ডিসেম্বরের মধ্যে তপশিল ঘোষণা করা হবে বলেও জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
গতকাল রাতে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ফেব্রুয়ারি বেশি দূরে নয়। নির্বাচন নিয়ে প্রস্তুতি নিতে নিতেই ভোটের দিন এসে পড়বে। বহু বছর আমরা কেউ ভোট দিতে পারিনি। এবার আমরা সবাই ভোট দেব। কেউ বাদ যাবে না। সবাই যেন বলতে পারি নতুন বাংলাদেশ গড়ার পথে দেশকে রওনা করার জন্য আমি আমার ভোটটা দিয়েছিলাম।
তিনি বলেন, নির্বাচন আসছে। যদি আপনি আপনার নির্বাচনি এলাকা থেকে দূরে বসবাস করেন তবে এখন থেকে নিয়মিত নির্বাচনি এলাকা পরিদর্শন করুন। যাতে সেরা ব্যক্তিকে নির্বাচিত করতে আপনি প্রস্তুত হতে পারে।
প্রধান উপদেষ্টা তার ভাষণে দাবি করেছেন, জাতীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, অর্থনীতিতে গতিশীলতা এসেছে, সংকট দূর হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তবে নির্বাচনের আগে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ। আজ (গতকাল), জুলাই গণঅভ্যুত্থান দিবসে, সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নিয়ে আমরা জাতির কাছে জুলাই ঘোষণাপত্র উপস্থাপন করেছি। এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান। আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।
তিনি জানান, তারা এখন অন্তর্বর্তী সরকার থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছেন।
প্রসঙ্গত, এর আগে গত বছর দায়িত্ব গ্রহণে চার মাসের মাথায় জাতির উদ্দেশ্যেই দেওয়া ভাষণে তিনি ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছিলেন। পরবর্তীতে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দেখা দেয় টানাপোড়েন। বিএনপির পক্ষ থেকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপ ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর। গত ১৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২০২৬ সালের রমজানের আগেই বাংলাদেশে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে জানানো হয়। দুই নেতার বৈঠক শেষে দেওয়া যৌথ বিৃবতিতে এ বিষয়ে জানানো হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য ওই সময়ের মধ্যে সংস্কার ও বিচারের বিষয়ে পর্যাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করা প্রয়োজন বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
পরবর্তীতে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ডিসেম্বরের মধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করার নির্দেশ দিলেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ নিয়ে প্রায় প্রতিদিনই বক্তব্য দিয়েছেন বিএনপি নেতারা। যদিও এ সময়ে নির্বাচনের যথার্থ পরিবেশ নিশ্চিতে দেশের আইনশৃঙ্খলার দুর্বল পরিস্থিতি তুলে ধরে জুলাই সনদ ও মৌলিক সংস্কারসহ বেশকিছু বিষয়ে এনসিপি এবং জামায়াত নেতারা একই সুরে কথা বলছেন। উভয় দলই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে রয়েছে সহাবস্থানে ছিল। দুই দলের অবস্থানকে সমর্থন দিয়েছে ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল। আর মৌলিক সংস্কার ও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ অনেকে।
সম্প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, যেসব বিষয়ে আলোচনা অগ্রসর হয়েছে, সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় কমিশন। এই প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি নিতে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছে অনেক রাজনৈতিক দল। তারা বলছে, অন্তর্বর্তী সরকারের ঘোষিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন করতে হলে ভোটের প্রস্তুতি এখন থেকেই নেওয়া জরুরি। তবে সংস্কার ও জুলাই সনদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও উদ্বেগ জানিয়েছেন কেউ কেউ।
এ ছাড়াও সাম্প্রতিক সময়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও সহসাই নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হবে বলে জানান গণমাধ্যমে। গত ৩১ জুলাই সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, ‘আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ কিছু দিনের মধ্যে ঘোষণা করা হবে।’ নির্বাচনের তারিখ নিয়ে এক প্রশ্নে আইন উপদেষ্টা বলেন, ‘জাস্ট ওয়েট করেন, কিছু দিনের মধ্যে ঘোষণা শুনবেন। নির্বাচনি কার্যক্রম তো নির্বাচন কমিশন দেখবে। আমি শুধু আমাদের সরকারের নিয়তের কথা আপনাদের বলতে পারি। আমাদের নিয়ত আছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে বেস্ট ইলেকশন দেওয়া। এটা প্রধান উপদেষ্টা আমাদের সবসময় বলেন।’
একই দিন সচিবালয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বাচন যথাসময়ে হবে। নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা যে সময়ের কথা বলেছেন, তার মধ্যেই হবে। এ বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার দৃঢ় অবস্থান। নির্বাচন নির্ধারিত সময়েই হবে, একদিনও দেরি হবে না তিনি বলেন। তবে আগামী পাঁচ-ছয় দিন সরকারের জন্য খুবই ক্রুশিয়াল টাইম। পাঁচ-সাত দিনে বোঝা যাবে, আমরা কোথায় যাচ্ছি।’ সাংবাদিকদের উদ্দেশে শফিকুল আলম বলেন, ‘একটা বিষয়ে নিশ্চিত থাকেন ইলেকশন (নির্বাচন) দেরি হবে না। প্রফেসর ইউনূস নির্বাচনের যে সময় বলেছেন, তার থেকে একটা দিনও দেরি হবে না।’
এদিকে নির্বাচনের জন্য ফুল গিয়ারে প্রস্তুতি চলছে বলে ইতোমধ্যেই জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে আসার পর গত ৮ জুলাই সাংবাদিকদের তিনি এই কথা জানান। একই কথা জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সচিব আখতার আহমেদও। গত সোমবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের সব প্রস্তুতি এখন জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে কেনাকাটা শেষ হয়ে যাবে। এরপরও কিছু কাজ থাকবে, যেগুলো সম্পর্কে পর্যালোচনা করে বলা যাবে।
তিনি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা যে টাইমলাইন দিয়েছেন, সে অনুযায়ী কাজ করছি। এরই মধ্যে সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। ১০ আগস্টের মধ্যে দাবি-আপত্তি জানানোর সময় রয়েছে। এরপর শুনানি শেষে আগস্টের মধ্যেই সীমানা চূড়ান্ত করার পরিকল্পনা রয়েছে। নির্বাচন পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধনের জন্য আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। ১০ আগস্টের মধ্যে আবেদন পেলে বিধি অনুযায়ী চূড়ান্ত করা হবে। এরই মধ্যে সীমানা আইন সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটার তালিকা সংশোধন অধ্যাদেশ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা, স্থানীয় পর্যবেক্ষক নীতিমালা, বিদেশি পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যম নীতিমালা, পর্যবেক্ষক সংস্থা নীতিমালা জারি ও আবেদন আহ্বান করা হয়েছে। আগামী বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সভা রয়েছে। এতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনের প্রস্তাব চূড়ান্ত করা হবে। রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালাও চূড়ান্ত হতে পারে। আচরণবিধিতে এআই অপব্যবহার রোধে কার্যকর ব্যবস্থা রোধেও কারিগরি ব্যবস্থাও বিধিতে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি আরও জানান, ভোটের জন্য সব ধরনের নির্বাচন সামগ্রীর কেনাকাটা ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে শেষ করা হবে। অনলাইনে নিবন্ধনের মাধ্যমে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে প্রবাসীদের ভোটদানসংক্রান্ত প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। এতে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে। শিগগিরই পরিকল্পনা কমিশনের আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পাওয়া যাবে।
দল নিবন্ধন বিষয়ে তিনি জানান, নিবন্ধিত ৫১টি দলের মধ্যে ৩০টি গত ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে তাদের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। ১৫টি দল সময় বাড়াতে আবেদন করেছে। বাকি ছয়টি দলের মধ্যে পাঁচটি প্রতিবেদন দেয়নি। একটি এ বছর নিবন্ধন পাওয়ায় দলটি এবার প্রতিবেদন দেয়নি। দল নিবন্ধনের জন্য ১৪৫টি দল আবেদন করেছিল। তথ্য ঘাটতি পূরণ চেয়ে চিঠি দেওয়ার পর ৩ আগস্টের মধ্যে ৮০টি দল প্রয়োজনীয় নথি দিয়েছে।