রাজধানীর পুরান ঢাকার মিটফোর্ডের ঘটনার মতো এবার গাজীপুরে জনসমক্ষে আসাদুজ্জামান তুহিন (৩৮) নামে এক সাংবাদিককে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে চান্দনা চৌরাস্তায় এ নৃশংস হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার এক দিন আগে গত বুধবার বিকেলে মহানগরীর সদর মেট্রো থানার অদূরে অপর এক সাংবাদিক আনোয়ার হোসেনকে প্রকাশ্যে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে আঘাত করে পা ও শরীর থেঁতলে দিয়ে গুরুতর জখম করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় ওই সাংবাদিক বাঁচার জন্য আকুতি জানালেও দুর্বৃত্তদের মন গলেনি। ঘটনাস্থলে পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকলেও বাঁচাতে এগিয়ে আসেনি কেউ। এ-সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ভিডিওতে দেখা যায়, দুর্বৃত্তরা নির্মমভাবে মারধর করে আনোয়ারের বুকের ওপর উঠে লাফায়। ভিডিওটি গতকাল রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে জনমনে ক্ষোভ ও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, নিহত সাংবাদিক তুহিন ও আহত আনোয়ার বিএনপির এক স্থানীয় নেতার চাঁদাবাজি নিয়ে খবর প্রকাশ করেছিলেন। নিহত আসাদুজ্জামান তুহিন দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুরের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এবং আনোয়ার হোসেন দৈনিক বাংলাদেশের আলো পত্রিকার সাংবাদিক। বর্বরোচিত এ ঘটনায় এরই মধ্যে ফুঁসে উঠেছে গাজীপুর। বিভিন্ন গণমাধ্যম, সামাজিক সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন এবং সাধারণ মানুষ হত্যার দ্রুত বিচার ও অপরাধীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন। আজ শুক্রবার সকালে গাজীপুর প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন স্থানে সাংবাদিকেরা বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে চান্দনা চৌরাস্তার ফুটপাত ও দোকানপাট থেকে চাঁদাবাজির বিষয়ে লাইভ করেন তুহিন। পরে রাত ৮টার দিকে তিনি নিজ ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট করে লেখেন, ‘যেমন খুশি তেমন রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য। গাজীপুর চৌরাস্তা।’ পরে তিনি মসজিদ মার্কেটের সামনে একটি চায়ের দোকানে বসে ছিলেন। এ সময় কয়েকজন মুখোশধারী সন্ত্রাসী তার ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। ধারালো অস্ত্র দিয়ে লোকজনের সামনেই কুপিয়ে ও গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা করে পালিয়ে যায় তারা। ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান এই সংবাদকর্মী।
ঘটনার খবর পেয়ে বাসন থানার পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে পাঠিয়েছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ওসি শাহীন খান। তিনি জানান, কী কারণে এ হত্যাকা-, তা জানার চেষ্টা চলছে। তদন্তে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো।
পুলিশ সূত্র জানায়, আসাদুজ্জামান তুহিন থাকতেন গাজীপুর মহানগরীর চৌরাস্তা এলাকায়। পূর্বশত্রুতার জেরে পাঁচ-ছয়জন দুর্বৃত্ত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় তাকে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ধাওয়া করে। এ সময় তিনি দৌড়ে ঈদগাহ মার্কেটের একটি চায়ের দোকানে আশ্রয় নেন। পরে দুর্বৃত্তরা তাকে দোকানের ভেতরে ঢুকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে। একপর্যায়ে তার মৃত্যু নিশ্চিত হলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়।
স্থানীয় ব্যবসায়ী খায়রুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দোকানে বসে ছিলাম। হঠাৎ তুহিন দৌড়ে এসে আমার দোকানে ঢুকে পড়ে। পরে তিনজন আমার দোকানের ভেতরে ঢুকে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। এ সময় দোকানের বাইরে দুজন রামদা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি বাধা দিতে গেলে তারা আমাকেও কুপিয়ে হত্যার হুমকি দেয়।’ তিনি আরও বলেন,
‘ওই সময় অনেক লোক তাকিয়ে দেখেছে, কিন্তু কেউ বাঁচাতে আসেনি।’
সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের ফেসবুক প্রোফাইল ঘেঁটে দেখা গেছে, চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় ফুটপাত ও দোকানপাট থেকে চাঁদাবাজি নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি লাইভ করেছেন। এ ছাড়া গতকাল রাত ৮টার দিকে চৌরাস্তা এলাকার একটি ভিডিও শেয়ার করে লেখেন, ‘যেমন খুশি তেমন রাস্তা পার হওয়ার দৃশ্য, গাজীপুর চৌরাস্তা।’ এর দুই ঘণ্টা আগে জয়দেবপুর রেলগেটের দেয়ালের পাশের একটি ছবি দিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জয়দেবপুরে যারা যাতায়াত করেন, এই রাস্তাটুকু আপনাদের চেনা। ড্রেন সংস্কার না করায় এত সুন্দর রাস্তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় জনগণের সম্পদ নষ্ট হচ্ছে।’
গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপকমিশনার রবিউল হাসান বলেন, আমরা এ ঘটনার কিছু ভিডিও ফুটেজ হাতে পেয়েছি। কিছু ক্লুও পেয়েছি। আমরা এ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে অভিযান শুরু করেছি। একজন সাংবাদিককে এভাবে কুপিয়ে হত্যা খুবই দুঃখজনক।’ এদিকে এই নৃশংস হত্যাকা-ে সাংবাদিক সমাজ, সহকর্মী ও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ‘দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ’ পরিবার শোকাহত।
পত্রিকাটির সম্পাদক খায়রুল আলম রফিক এক শোকবার্তায় বলেন, ‘আমাদের প্রাণপ্রিয় সহকর্মী, সত্য ও নির্ভীক সংবাদযোদ্ধা আসাদুজ্জামান তুহিনের নির্মম হত্যাকা-ে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি। তুহিন শুধু আমাদের সহকর্মী ছিলেন না, ছিলেন পরিবারের একজন বলিষ্ঠ সদস্য। সত্যের পক্ষে তার অবস্থান ছিল অবিচল। এই হত্যাকা- প্রমাণ করে, সমাজে সৎ সাংবাদিকতা কতটা হুমকির মুখে। আমি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানাই, দ্রুততম সময়ের মধ্যে খুনিদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হোক।’
অন্যদিকে চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় পুলিশের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে আনোয়ার হোসেন নামে অপর এক সাংবাদিককে বেধড়ক পিটিয়ে গুরুতর আহত করেছে একদল দুর্বৃত্ত। গত বুধবার বিকেলে গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর শহরের সাহাপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, জয়দেবপুর রেলগেট ও সাহাপাড়া এলাকায় ফুটপাত থেকে অবৈধভাবে চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করায় ক্ষিপ্ত হয়ে দুর্বৃত্তরা আনোয়ার হোসেনকে বেধড়ক মারধর করে। তারা ইট দিয়ে তার পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে দেয়। হামলার সময় পাশেই পুলিশ অবস্থান করলে প্রথমে তাকে উদ্ধারে কেউ এগিয়ে আসেনি। পুলিশ ঘটনাটি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল বলে জানান স্থানীয়রা। মারধরের একপর্যায়ে আহত আনোয়ার যখন রাস্তায় নিস্তেজ হয়ে পড়েন, তখন পুলিশ এগিয়ে তাকে উদ্ধার করে গাজীপুর শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, গাজীপুর মহানগরীর জয়দেবপুর রেললাইনের উত্তর পাশে রেলের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে একটি ফলের মার্কেট গড়ে উঠেছে। ওই অবৈধ ফলের দোকানগুলোর সামনের রাস্তায় এক যুবককে কতিপয় দুর্বৃত্ত মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ সময় কয়েকজন ওই যুবককে এলোপাতাড়ি মারছে। লাঠি দিয়ে আঘাত করছে, কেউ লাথি মারছে। কিছু দূর টেনে নেওয়ার পর এক দুর্বৃত্ত যুবকের দিকে উত্তেজিত হয়ে ইট নিয়ে যাচ্ছে আঘাত করার জন্য। একপর্যায়ে সে ইট দিয়ে একাধিকবার আঘাত করে পা ও শরীর থেঁতলে দেয়। হামলাকারীরা তাকে নির্মমভাবে মারধর করে তার বুকের ওপর উঠে লাফায়। একপর্যায়ে পায়ের ওপর ইট দিয়ে থেঁতলে দেয় এবং টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় সবার মনে পুরান ঢাকার মিটফোর্ডের সামনে ব্যবসায়ী লাল চাঁদ ওরফে সোগাগের নৃশংস পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে দেওয়ার ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।
শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আনোয়ার হোসেনের পায়ে মারাত্মক জখম হয়েছে এবং শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এ ঘটনায় আনোয়ার হোসেনের মা আনোয়ারা বাদী হয়ে কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে সদর মেট্রো থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন।
গাজীপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ) তাহেরুল হক চৌহান বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওটি পাঠানোর পর তিনি দেখেছেন। ঘটনাটি খুবই মর্মান্তিক। হামলার শিকার ব্যক্তির বিরুদ্ধে কারও কোনো অভিযোগ থাকলে আমরা আইনি ব্যবস্থা নেব। কিন্তু এভাবে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। অভিযুক্তদের শনাক্ত করে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’