ঢাকা শুক্রবার, ০৮ আগস্ট, ২০২৫

অন্তর্বর্তী সরকারের এক বছর

নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের বিকল্প নেই

সম্পাদকীয়
প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২৫, ০৩:৫৭ এএম

অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার এক বছর পূর্ণ করেছে। গত বছরের ৮ আগস্ট নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা, গণঅভ্যুত্থান এবং রাষ্ট্রীয় শূন্যতার প্রেক্ষাপটে এই সরকার দায়িত্ব নেয়। সাংবিধানিক কাঠামোর বাইরে গিয়ে গঠিত হওয়ায় সরকার গঠনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, তবে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ অনুযায়ী শপথ গ্রহণের মাধ্যমে একটি আইনগত গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত হয়।

এই এক বছর সরকার বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ভেঙে পড়া এবং ‘মব ভায়োলেন্স’-এর উত্থান। হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্যানুসারে, মাত্র ছয় মাসে ১৯৪টি গণপিটুনির ঘটনায় ১২১ জন নিহত হয়েছেন। সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় বিপুল প্রাণহানি ও আহতের ঘটনা উদ্বেগজনক।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও চিত্র মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা কষ্টকর হয়ে উঠেছে, খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছে, এবং ব্যাংক খাতে নন-পারফরমিং ঋণের পাহাড় তৈরি হয়েছে। প্রবৃদ্ধি ৪ শতাংশে নেমে আসা অর্থনীতির স্থবিরতা এবং বিনিয়োগ স্থবিরতারই প্রতিচ্ছবি।

রাজনৈতিক অঙ্গনেও বিভাজন বিদ্যমান। সরকার গঠনের শুরুতে বিএনপি ও জামায়াতের সমর্থন থাকলেও এনসিপির প্রতি সরকারের আনুকূল্যে সেই সমর্থনে ভাটা পড়ে। সাংবিধানিক কাউন্সিল ও নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে বিভিন্ন দলের মতানৈক্য রয়েছে। একদিকে জামায়াত ও নবীন রাজনৈতিক শক্তি পিআর পদ্ধতির পক্ষে, অন্যদিকে বিএনপি তাতে স্পষ্ট বিরোধিতা জানিয়েছে।

সংস্কার প্রক্রিয়ার গতি অত্যন্ত ধীর। যদিও ১১টি কমিশন গঠন করে প্রতিবেদন গ্রহণ করা হয়েছে এবং ১২১টি তাৎক্ষণিক বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ গৃহীত হয়েছে, বাস্তবায়নে গতি দেখা যায়নি। একইভাবে, স্বৈরাচারী সরকারের অপরাধ বিচারে জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে সরকারের বাস্তব পদক্ষেপের ফারাক রয়ে গেছে।
আন্তর্জাতিক পরিম-লেও অন্তর্বর্তী সরকার কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি এবং পুশইন নীতির বাস্তবায়ন দুই দেশের সম্পর্ককে সংকটময় করে তুলেছে। এ বিপরীতে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে, যা কূটনীতিতে ভারসাম্য আনার চেষ্টা হিসেবে দেখা যেতে পারে।

এই এক বছরে অন্তর্বর্তী সরকার স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় কিছু ইতিবাচক অগ্রগতি দেখিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা, গার্মেন্টস ও ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা এবং এনবিআরের পুনর্গঠন কিছুটা হলেও প্রশাসনিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছে।

তবে এখনো ‘নতুন বাংলাদেশ’-এর স্বপ্ন বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং আইনের শাসনের পূর্ণ প্রতিষ্ঠা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও নিরাপত্তা বাহিনীর ভূমিকা আরও সক্রিয় হতে হবে। বিচার এবং প্রশাসনিক সংস্কারে গতি বাড়াতে হবে। ইতোমধ্যে সরকার নির্বাচনের তারিখ ষোঘণা করেছে এই পরিস্থিতিতে দেশে একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে গেলে এই বিষয়টিকে অবশ্যই গুরুত্বসহকারে দেখতে হবে সরকারকে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, সব রাজনৈতিক দলকে একটি অভিন্ন লক্ষ্যে, দেশের কল্যাণে, একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। মতভেদ থাকবে, কিন্তু সমঝোতার ভিত্তিতে এগোতে হবে। এই সরকারের দায়িত্ব ভবিষ্যতের জন্য একটি বিশ্বাসযোগ্য ভিত্তি তৈরি করা, যার ওপর দাঁড়িয়ে একটি গণতান্ত্রিক সরকার দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে পারবে।

সবশেষে বলতেই হয়, জুলাই অভ্যুত্থানের পর সমস্ত জাতি আশায় বুক বেঁধেছিল একটি নতুন বাংলাদেশের প্রত্যাশায়। যার দায়িত্ব নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন তখনই বাস্তবায়ন সম্ভব, যখন সেই স্বপ্নের মূল চালিকাশক্তি হবে জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সদিচ্ছা। সব বিভাজনের ঊর্ধ্বে উঠে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’এই মানসিকতা প্রতিষ্ঠা করাই এখন সময়ের দাবি।