স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন ও ভাতা আদেশ-২০১৫ অনুযায়ী, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি বাসস্থানে বসবাস করেন তারা বাড়ি ভাড়া ভাতা প্রাপ্য হবেন না। অথচ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ডি-টাইপ বাসায় বসবাসকারী সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের বেতন থেকে বাড়িভাড়া ভাতার ৫০ শতাংশ কেটে রাখা হয়।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের বাসায় বসবাসকারীদের কাছ থেকে কর্তন করা হচ্ছে ২৫ শতাংশ টাকা। এক্ষেত্রে তাদের কাছ থেকে বাড়িভাড়া ভাতার শতভাগ কর্তনের কথা।
বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যুক্তি দিচ্ছে, ৩০১তম সিন্ডিকেট সভার সিদ্ধান্ত মতেই টাকা কম কেটে রাখা হচ্ছে। আর মীর মরাশররফ হোসেন হলের বাসাগুলো জরাজীর্ণ হওয়ায় ২৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া কর্তন করা হচ্ছে। একইচিত্র চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কোয়ার্টারেও বসবাসকারী চাকরিজীবীদের। এখানে তাদের বেতন বিল হতে প্রাপ্ত বাড়ি ভাড়া ভাতা থেকে ৫০ শতাংশ অর্থ কেটে রাখা হয়। এভাবেই দেশের ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাস করা সত্ত্বেও শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের বেতন বিল হতে নির্ধারিত টাকা থেকে কম বাড়ি ভাড়া কর্তন করায় গত দুই বছরের সরকারের ৩০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ৩২২ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে।
এ ছাড়াও আর ২১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ৪৬ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ১৮৩ টাকা নানাভাবে অগ্রীম নিয়ে তা পরিশোধ করছেন না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অগ্রীম ঋণ নেওয়ার ৬ মাসের মধ্যে তা পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু শিক্ষকরা তা দীর্ঘদিন থেকে পরিশোধ করছেন না। এর বাইরেও ৪ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাপ্ততার অতিরিক্ত সম্মানি প্রদান করায় সরকারের ক্ষতি হয়েছে আরও ৭ লাখ সাইত্রিশ হাজার টাকা।
শিক্ষা বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘদিন থেকে শিক্ষকরা নানা অজুহাতে এ ধরনের জোচ্চুরি করে আসছেন। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
সম্প্রতি শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের ২০২১-২২ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই অনিয়মের চিত্র। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে (ইউজিসি) প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছে অধিদপ্তরটি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ বলেন, শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর যেসব বিষয়ে আপত্তি তুলেছে তার জবাব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দিবে। আর শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমাদের এই বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নিব।
বাসা ভাড়া কম দেওয়ায় ৩০ কোটি ৮৫ লাখ লাখ টাকা গচ্চা : দেশের ১৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা বরাদ্দের নথি ও বেতন বিল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি কোয়ার্টারে বসবাস করলেও তাদের কাছ থেকে নির্ধারিত হারে বাসা ভাড়া কর্তন করা হয় না। এতে গত দুই অর্থবছরের সরকারের ৩০ কোটি ৮৫ লাখ ৯১ হাজার ৩২২ টাকা আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। তবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় তাদের বাসা স্ট্যান্ডার্ড মানের না হওয়ার অজুহাত দেখিয়ে বাসা ভাড়া কম রাখবে বলে জানাচ্ছে।
স্বশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেতন ও ভাতা আদেশ-২০১৫ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী সরকারি বাসস্থানে বসবাস করেন তারা ভাড়ি ভাড়া ভাতা প্রাপ্য হবেন না। অথচ এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোয়ার্টারে বসবাস করা সত্ত্বেও বাসা ভাড়া ভাতার বড় অংশ নানা অজুহাতে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন। কেন এই অনিয়ম করা হচ্ছে অডিট অধিদপ্তর তার জবাব চাইলেও ঠিকমতো উত্তর দেয়নি অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়।
৬টি বিশ্ববিদ্যালয় কোনো জবাবই দেয়নি, ৭টি বিশ্ববিদ্যালয় যে জবাব দিয়েছে তা যথাযথ নয় বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর। অধিদপ্তর বলছে, আপত্তিকৃত অর্থ আদায়পূর্বক বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা করা এবং অনিয়মের পুনরাবৃত্তি রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা অবশ্যক। গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, যশোর, পাবনা ও খুলনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, কুমিল্লা, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট কৃষি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।
সাড়ে ৪৬ কোটি টাকা অগ্রীম নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না :
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ অগ্রীম বিল কিংবা ঋণ নিলে ৬ মাসের মধ্যে সমন্বয় কিংবা ফেরত দেওয়ার কথা। অথচ দেশের ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ৪৬ কোটি ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ১৮৩ টাকা নানাভাবে অগ্রীম নিয়ে পরিশোধ করছেন না। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-ইউজিসি, এই অর্থ সমন্বয় করে রাখার জন্য বরাবার চিঠি দিলেও তা আমলে নিচ্ছে না বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কেন সমন্বয় করে রাখা হচ্ছে না তার জবাব চেয়েছিল শিক্ষা অডিট অধিদপ্তর। এর জবাবে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই বলছে, দ্রুত এসব টাকা সমন্বয় করা হবে। আবার কেউ কেউ বলছে গবেষণা কাজসহ কিছু জরুরি কাজে প্রদানকৃত টাকা সমন্বয় করতে সময় লাগছে।
নথি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিগত দুই অর্থবছরের পরীক্ষা সংক্রান্ত সভা, আনুষঙ্গিক ব্যয়, প্রশিক্ষণ, আপ্যায়ন, দাপ্তরিক ক্রয়, জ্বালানি, মেরামত ও বিবিধ খরচের উদ্দেশ্যে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের এই টাকা অগ্রীম দেওয়া হয়। অগ্রীম টাকা দেওয়া নিয়ে ইউজিসির গাইডলাইন মতে, অগ্রীম টাকা গ্রহণের ৬ মাস অথবা প্রতি বছরের ৩০ জুনের মধ্যে সমন্বয় করতে হবে।
গোপালগঞ্জ, পটুয়াখালী, খুলনা, যশোর, নোয়াখালী, জামালপুর, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়-বুয়েট, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়া, ঢাকা, খুলনা, চট্টগ্রাম, জগন্নাথ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজ এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। আপত্তিকৃত এই অর্থ দ্রত ফেরত আনার সুপারিশ করছে অডিট অধিদপ্তর।
এর মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবথেকে বেশি আর্থিক অনিয়ম হয়েছে ২০ কোটি ২৩ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এ ছাড়া যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ কোটি ৭৪ লাখ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ কোটি ৩৩ লাখ টাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২ কোটি ৪৪ লাখ টাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬ কোটি ৬৫ লাখ টাকার আর্থিক অনিয়ম হয়েছে।
প্রাপ্ততার অতিরিক্ত ৭ লাখ টাকা সম্মানি :
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশমতে, প্রশ্নপত্র প্রণয়ের জন্য নির্বাচন কমিটির সদস্য/বিশেষজ্ঞগণ একাধিক পদের পরীক্ষা হলেও দৈনিক একটি সম্মানিপ্রাপ্ত হবেন আবার একই কার্যদিবসে লিখিত, মৌখিক ও ব্যবহারির পরীক্ষা গ্রহণ করা হলে ২টি সম্মানিপ্রাপ্ত হবে। অথচ আদেশ লঙ্ঘন করে দেওয়া হয়েছে একাধিক সম্মানি। এতে ৭ লাখ ৩৭ হাজার ৫৫০ টাকা বেশি সম্মানি দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুর এবং জামালপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গাজীপুর ডিজিটাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িত। আপত্তিকৃত অর্থ জড়িত ব্যক্তিবর্গের নিকট থেকে আদায় করে বিশ্ববিদ্যালয় তহবিলে জমা করা আবশ্যক বলে সুপারিশ করেছে অধিদপ্তর।
ক্যাশ বইয়ের সঙ্গে ব্যাংক হিসাবে ২০ কোটি ৮৪ লাখ টাকার গরমিল :
এ ছাড়াও এই দুই অর্থবছরে ৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাশ বই সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ না করার কারণে ব্যাংক হিসাবের সঙ্গে ২০ কোটি ৮৪ লাখ ১৭ হাজার ৮২১ টাকা গরমিল পাওয়া গেছে। অডিট অধিদপ্তর বলছে, অর্থবছর শেষে ক্যাশ বই ও ব্যাংক বিবরণীর যোগফল একই হবে। এই ৫ বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে গরমিল। তবে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই গরমিল পাওয়া গেছে তা উল্লেখ করা হয়নি। এই ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে অধিদপ্তর।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন