সিলেটের পাথর ও বালু লুটপাটে বিএনপি, জামায়াত, আওয়ামী লীগ, এনসিপি, প্রশাসন, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জড়িত নেই? ঐকমত্যের ভিত্তিতে এই লুটপাটের কথা এত দিন মুখে মুখে চাউর থাকলেও এখন দুদকের অনুসন্ধানে তা সামনে এসেছে।
কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথরের পাথর লুটের টাকার ভাগ খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার অফিস, জেলা প্রশাসন, পুলিশ সুপার, কোম্পানীগঞ্জের ইউএনও, ওসি, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পেলেও অভিযোগ ওঠার পর বদলি করা হয়েছে সিলেটের ডিসি মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদকে। ওএসডি এবং কোম্পানাীগঞ্জের ইউএনও আজিজুন্নাহারকে বদলি করা হয়েছে।
কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে পাথরকা-ের অন্যতম হোতা কোম্পানীগঞ্জের ওসি, বিভাগীয় কমিশনার, পুলিশ সুপার, খনিজ উন্নয়ন ব্যুরোসহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য কর্মকর্তা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নেওয়া এবং সিলেটের ডিসিকে ওএসডি এবং ইউএনওকে সাধারণ বদলি করায় সন্দেহের চোখে দেখছেন স্থানীয়সহ পরিবেশবাদীরা।
তারা বলছেন, দুই কর্মকর্তাকে ওএসডি এবং বদলির মাধ্যমে আসলে তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে। অথচ উচিত ছিল অপরাধ শনাক্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া। তা না করে তাদের সেইফ জোনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া জড়িত অন্যরা এখনো বহাল তবিয়তে। তারা নানাভাবে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
একই অবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোর ক্ষেত্রেও। দুদকের তদন্তে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে বিএনপির ২০ জন, আওয়ামী লীগের ৭ জন, জমায়াতের ২ জন, এনসিপির ২ জন রয়েছেন। এর মধ্যে অভিযোগ ওঠার কয়েক দিন আগে শুধু বিএনপি তাদের কোম্পানীগঞ্জ সভাপতি সাহাব উদ্দিনের পদ স্থগিত করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দিনভর দুদকের তদন্ত প্রতিবেদনে নাম আসার পর তোলপাড় শুরু হলেও কোনো দলই তাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি।
সিলেট বিভাগ গণদাবি পরিষদের সভাপতি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট চৌধুরী আতাউর রহমান আজাদ বলেন, দায়মুক্ত করলে পাথর লুটের একটি অপরাধী পক্ষকে নিরাপদ করে দেওয়া হবে। সুশাসনের জন্য তা অশুভ লক্ষণ। এটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে আরও ভেঙে দেবে এবং অনৈতিকতায় উৎসাহিত করবে। একটি কল্যাণরাষ্ট্রের জন্য এটি ইতিবাচক নয়।
দুদক সূত্র জানায়, পাথর চুরির ঘটনায় খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবী, বিদায়ি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ, কোম্পানীগঞ্জের বিদায়ি চার নির্বাহী কর্মকর্তা যথাক্রমে আজিজুন্নাহার, মোহাম্মদ আবুল হাসনাত, ঊর্মি রায় ও আবিদা সুলতানা, সিলেটের পুলিশ সুপার মাহবুবুর রহমান, কোম্পানীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ উজায়ের আল মাহমুদ আদনান ও বিজিবির দায় রয়েছে। দুদকের তদন্তে তাদের কর্তব্যে অবহেলার বিষয়টিও উঠে আসে।
এ ছাড়া এ ঘটনায় চারটি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ ৪২ জন পাথর লুটে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত বলে উল্লেখ করা হয় দুদুকের প্রতিবেদনে। গত ১৩ আগস্ট এনফোর্সমেন্ট পরিচালনা করে প্রাথমিকভাবে যে তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে, তা নিয়ে ১৬ আগস্ট ঢাকায় প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন দুদক সিলেটের উপপরিচালক রাফী মো. নাজমুস সাদাৎ।
একাধিক সূত্র জানায়, দুদক এবং গণমাধ্যমে পাথর ও বালু লুটের ঘটনায় একাধিক সরকারি কর্মকর্তার দায় থাকলেও বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে শুধু সিলেটের ডিসি মাহবুব মুরাদকে। সব দায় তার কাঁধে তুলে দিয়ে তাকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে ঢাকায়। আর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহারকে বদলি করা হলেও তাকে রাখা হয়েছে সিলেটে।
দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার। তাকে সিলেটের আরেক বালুমহাল এলাকাতেই বদলি করা হয়েছে। পাথর ও বালু লুটের দায়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এই বদলিকে অনেকে তাদের সেইফ জোনে পাঠানো হয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
একটি সূত্রের দাবি, কোম্পানীগঞ্জের পাথর থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে লুটের সুযোগ করে দেন ইউএনও। বন ও পরিবেশ উপদেষ্টার কথায় এবং দুদকের তদন্তে সেটি উঠেও এসেছে। কিন্তু তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না নিয়ে কিংবা তার ব্যাংক হিসাব তলব না করে তাকে বরং সেখান থেকে বদলি করে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সিলেটের বিভাগীয় কমিশনারের আদেশে তাকে ফেঞ্চুগঞ্জে বদলি করা হয়। এটিকে অনেকে পুরস্কার হিসেবে দেখছেন।
সাদাপাথর লুটের ঘটনায় আলোচিতদের মধ্যে নাম জড়িয়ে আছে সিলেটের এসপি মাহবুবুর রহমান এবং কোম্পানীগঞ্জের ওসি ও বিদায়ি জেলা প্রশাসক মাহবুব মুরাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধু উজায়ের আল মাহমুদ আদনানের। দুদক তাদের প্রতিবেদনেও তাই বলছে। এরই মধ্যে গণমাধ্যমে প্রচারিত খবরে পাথরকাণ্ডে তাদের সংশ্লিষ্টতার কথা আলোচিত হলেও তারা এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। কৌশলে পুরো লুটকাণ্ডে থেকে তাদের আড়ালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
সিলেট বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের একটি সূত্র জানায়, বিভাগীয় কমিশনার খান মো. রেজা-উন-নবীর একটি বক্তব্যের পরই সাদাপাথরসহ সিলেটের পাথর ও বালু লুটপাটের মহাযজ্ঞ চালায় সর্বদলীয় লুটেরা। খান মো. রেজা-উন-নবী গত ৮ জুলাই তার কার্যালয়ে পাথর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এ সময় তিনি বলেন, ‘সারা দেশে পাথর উত্তোলন করা গেলে সিলেটে যাবে না কেন? এর সঙ্গে মানুষের জীবন ও জীবিকা জড়িত।’ তার এ বক্তব্যটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে পাথর লুটপাটে ব্যাপক উৎসাহ জুগিয়েছে।
সরকারিভাবে পাথর উত্তোলন নিষিদ্ধ থাকলেও তার এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে পাথর লুটপাটকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়। অভিযোগ উঠেছে, এ ক্ষেত্রে তিনি রাষ্ট্রীয় সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব পালনের পরিবর্তে পাথরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিক ও রাজনৈতিক নেতাদের অবৈধ স্বার্থরক্ষায় ভূমিকা রেখেছেন।
অনেকে বলছেন, তার চোখের সামনে তারই নখদর্পণে থাকা সিলেটের শীর্ষ পর্যটনকেন্দ্র লুট হয়ে গেল আর তিনি কিছুই জানলেন না দেখলেন না এটি কী করে অসম্ভব। তবে তিনি অস্বীকার করেছেন তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি।
জেলা প্রশাসনের একটি সূত্র জানায়, বিদায়ি সিলেট জেলা প্রশাসকের ব্যর্থতার জন্য বিভিন্ন মহল থেকে দায়ী করা হচ্ছে সিলেট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সিনিয়র অফিসার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক সুবর্ণা সরকার। তিনি গত ফ্যাসিস্ট সরকারের আমল থেকে সিলেটের জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে রয়েছেন।
সিলেটের প্রশাসনে তিনি আওয়ামীবান্ধব কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত। স্থানীয় সরকারে কাজ করার অভিজ্ঞতা বেশি থাকায় মাহবুব মুরাদের ছায়া হয়ে থাকতেন তিনি। তার সব সিদ্ধান্তে সুবর্ণা প্রভাব রাখতেন বেশি।
এদিকে বিএনপির একটি সূত্র জানায়, কোয়ারি ও বলুমহাল নিয়ে সুবর্ণা সরকারের পরামর্শেই জেলা প্রশাসক সব সিদ্ধান্ত নিতেন। মূলত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ শের মাহবুব মুরাদ থাকলেও তিনি ছায়া ডিসি হয়ে প্রশাসন চালাতেন। সিলেট সিটি করপোরেশনে জেলা প্রশাসকের তিনিই প্রতিনিধিত্ব করেন। গত জুলাই মাসে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে তার বদলির আদেশ এসেছিল।
কিন্তু অদৃশ্য কারণে তিনি সেই বদলি ঠেকাতে সক্ষম হন। এর ফলে তিনি এখনো সিলেটে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। গত বুধবার রাতে যখন নতুন জেলা প্রশাসক সারোয়ার আলম এসে সিলেট পৌঁছেন, বিমানবন্দরে সুবর্ণা সরকারই তাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেন। সেই ছবি খুব দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে দুদকের তালিকায় মহানগর বিএনপির শীর্ষ নেতাদের নাম আসার পর থেকে তোলপাড় চলছে সিলেটে। অনেকে বলছেন, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সিলেট জেলা বিএনপির নিয়ন্ত্রণাধীন। তাদের কোনো দায়িত্বশীল পাথরকাণ্ডে জড়ালে আশীর্বাদ থাকবে জেলার নেতাদের। এ নিয়ে জেলার এক নেতার নাম উচ্চারিতও হচ্ছিল। শাহাবুদ্দিন তার বলয়ের নেতা। কিন্তু দুদকের তালিকায় জেলার কারো নাম না এসে এসেছে মহানগরের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল হাসান কয়েস লোদী ও সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরীর।
এটি আলোচনাকে আরও উসকে দিয়েছে। সিলেটের বিএনপিতে যে কয়জন নেতা ক্লিন ইমেজের অধিকারী, মহানগরের সাধারণ সম্পাদক এমদাদ হোসেন চৌধুরী তাদের একজন। তিনি অত্যন্ত স্বজ্জন। সিলেটে তার নিজস্ব কোনো বলয় বা বাহিনীও নেই।
একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, গত শুক্রবার জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব হাফিজুর রহমান চৌধুরী তার গ্রামের বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জে বেড়াতে আসেন। পরদিন শনিবার তার বাড়িতে গিয়ে একান্তে বৈঠক করেন সিলেট জেলা বিএনপির শীর্ষ এক নেতা। এ সময় তাকে অনুরোধ জানানো হয়, সাদাপাথর ইস্যুতে বিএনপিকে যেন সেইফ জোনে রাখা হয়।
অপরদিকে সিলেট জেলা প্রশাসনের প্রশ্নবিদ্ধ কমিটির মাধ্যমে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার পর সিলেটে সেটি নিয়েও আলোচনা শুরু হয়েছে। তিন সদস্যের কমিটিতে যখন অভিযুক্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আজিজুন্নাহারকে সদস্য করা হয়, তখন এর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তাকে এই অভিযোগে বদলি করা হয়েছে। কেউ কেউ একে জেলা প্রশাসনের আইওয়াশ বলে মন্তব্য করেন।
বলেন, অভিযুক্ত নিজেই যদি বিচারকের চেয়ারে বসেন, তাহলে সেই বিচার কেমন হবে তা আগেই অনুমেয়। ফলে এই প্রতিবেদনের গ্রহণযোগ্যতা আগেই হারিয়ে গেছে।