ডাকসু নির্বাচনের মনোনয়ন চূড়ান্ত ও বিভিন্ন প্যানেল ঘোষণার পর জমে উঠেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ-ডাকসুর নির্বাচন। নির্বাচনে জয়ী হলে প্রার্থীরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের জন্য কী করবেন এমন প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছুড়ছেন তারা। শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করার পাশাপাশি গণরুম ও গেস্টরুম কালচার বন্ধ, বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা, চিকিৎসা, পরিবহন নিশ্চিতের পাশাপাশি রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি বন্ধের দিকে নজর সবার। যদিও এখনো কোনো প্যানেলই তাদের নির্বাচনি ইশতেহার ঘোষণা করেনি। তবে অনেক প্যানেলেরই ইশতেহার চূড়ান্তের পথে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রার্থীরা নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পাশাপাশি এক প্যানেল অন্য প্যানেলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগও সামনে আনছে। সব মিলিয়ে নির্বাচন ঘিরে সরগরম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ডাকসুর নির্বাচনের চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন ডাকসুর চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক জসীম উদ্দীন। এবার নির্বাচনে শীর্ষ তিন পদ সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে ৪৮ জন, সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ১৯ জন ও সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস) হিসেবে ২৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সব মিলিয়ে এই তিনটি পদপ্রার্থী ৯৫ জন। ডাকসু নির্বাচনে প্রাথমিক বৈধ প্রার্থী ৪৬২ জন, এর মধ্যে ৬০ জন নারী প্রার্থী। এ ছাড়া এবার ডাকসু নির্বাচনে মোট আটটি প্যানেল ইতিমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে।
প্যানেল ঘোষণার পর থেকে প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে কী করবেন সেই প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। গতকাল শুক্রবার ডাকসুর সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে শিবিরের ভিপি পদপ্রার্থী সাদিক কায়েম বলেছেন, শিবিরের প্যানেল বিজয়ী হলে নারী শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকটের সমাধান হবে। আমরা বিজয়ী হলে নারীদের আবাসন নিয়ে কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছি। এসবের সমাধান নিয়েই আমাদের ইশতেহার সাজানো হবে।
তিনি বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে এসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে শিক্ষার্থীদের হয়রানির শিকার হতে হয়। আমরা নির্বাচিত হলে ‘লাঞ্চের পরে আসুন’ টাইপের কথাবার্তা চলবে না। রেজিস্ট্রার বিল্ডিংকে আধুনিকায়ন করা হবে। এ ছাড়া, সেখানে শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম কাজের ব্যবস্থা থাকবে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী মধ্যবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসে। নির্বাচিত হলে শিক্ষার্থীদের আবাসন সংকট দূর করে তাদের মধ্যে মানসিক প্রশান্তি আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাব। যেন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালোভাবে থাকতে পারে এবং পড়ালেখা চালিয়ে যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ছাত্রদলের প্যানেল বিজয়ী হলে গণরুম ও গেস্টরুম কালচার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাটি থেকে চিরতরে মূলোৎপাটন করা হবে। ক্যান্টিনে ফাও খাওয়াসহ রাজনৈতিক যেসব অপসংস্কৃতি ছিল, সেসবের মূলোৎপাটন করা হবে।
বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের ঢাবি শাখার আহ্বায়ক ও সংগঠনটির ভিপি পদপ্রার্থী আব্দুল কাদের গতকাল বলেন, আমরা নির্বাচিত হলে আমাদের প্রধান লক্ষ্য থাকবে শতভাগ আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা। আমাদের স্লোগান হবে ওয়ান স্টুডেন্ট ওয়ান সিট। এ ছাড়া গণরুম-গেস্টরুম প্রথা ক্যাম্পাস থেকে চিরতরে নির্মূল করারও প্রতিশ্রুতি দেন তিনি।
দলটির জিএস পদপ্রার্থী ও কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার বলেন, আমাদের অন্যতম ইশতেহার হচ্ছে, আবাসিক হলগুলোয় ফ্রি ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া। ঢাবিতে স্টারলিংক সেবা চালু করা হবে এবং হিসাব করে দেখা গেছে, এর জন্য শিক্ষার্থীর মাথাপিছু মাত্র ৪০ টাকা খরচ হবে, যা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বা স্পন্সরশিপের মাধ্যমে সংগ্রহ করা সম্ভব।
ছাত্র অধিকার পরিষদের প্যানেলের ভিপি পদপ্রার্থী ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি ইয়ামিন মোল্লা বলেন, অনেক লড়াই-সংগ্রাম কওে, আমরণ অনশন করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ডাকসু নির্বাচনকে এই পর্যন্ত এনেছি। আপনারা নির্বাচন বানচাল করবেন, আমরা শিক্ষার্থীরা তা হতে দেব না। আমরা ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান বেড, ওয়ান টেবিল চাইÑ শিক্ষার্থীদের পার্টটাইম জব অথবা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে ইনকামের ব্যবস্থা করতে হবে।
ডাকসু নির্বাচনে স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্যের ব্যানারে ভিপি (সহ-সভাপতি) পদপ্রার্থী ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক মুখপাত্র উমামা ফাতেমা বলেন, ছাত্ররাজনীতি যাতে একটা সংস্কারের দিকে এগোয়, সেই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বাধ্য করা হবে। একাডেমিক বিষয়ের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক সংস্কারের দিকেও ফোকাস করা হবে। একাডেমিক ক্যাম্পাস হিসেবে গড়ে তোলার এটাই একটা সঠিক সময়। বিভাগ এবং একাডেমিক যে সমস্যা আছে, তা নিরসনে আমরা কাজ করব। এ ছাড়া ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসন সমস্যার সমাধান, মানসম্মত পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিতেও পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
‘সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল থেকে ভিপি পদপ্রার্থী ইয়াসিন আরাফাত বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩ থেকে ৪ শতাংশ শিক্ষার্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি বাকি সাধারণ শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেট নিয়ে কাজ করব। আমরা প্রথম গুরুত্ব দেব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান, খাদ্য, বাসস্থান, হলে সিট, চিকিৎসা, পরিবহন ও গবেষণাÑ এই বিষয়গুলোর প্রতি।’
সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদের ব্যানারে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদপ্রার্থী মাহিন সরকার বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতির ভবিষ্যৎ ও রূপরেখা কেমন হবেÑ এটা নিয়ে দেরিতে হলেও কাজ করার চেষ্টা করব। যদিও এ কাজ গত বছরের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়েই করার প্রয়োজন ছিল। পাশাপাশি শিক্ষার্থীরা নিয়মিত যে সমস্যাগুলোর সম্মুখীন হয়, সেগুলো নিয়ে কাজ করব। এর মধ্যে রয়েছে রেজিস্ট্রার ভবন ডিজিটালাইজেশন করা, খাবারের ভর্তুকি বাড়ানো, কথা বলা-সমালোচনা করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা ইত্যাদি।
প্রচারণামূলক বিলবোর্ড-ব্যানার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ
ডাকসু নির্বাচন ঘিরে টাঙানো প্রচারণামূলক বিলবোর্ড-ব্যানার সরিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল শুক্রবার ডাকসুর চিফ রিটার্নিং অফিসার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দীনের সই করা এক বিবৃতিতে এই তথ্য জানানো হয়। বিবৃতিতে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী ও সংশ্লিষ্ট পক্ষের উদ্দেশে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেসব প্রচারণামূলক বিলবোর্ড/ব্যানার টাঙানো রয়েছে কিংবা এরই মধ্যে টাঙানো হয়েছে, সেগুলো অনতিবিলম্বে সরিয়ে ফেলতে হবে। প্রচারণা শুরুর নির্ধারিত দিন থেকে আচরণবিধি অনুযায়ী প্রচারকাজ চালানো যাবে।
এর আগে, অন্য একটি বিবৃতিতে নির্বাচন কমিশন জানায়, ২২ থেকে ২৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রচারণা চালানো আচরণবিধি লঙ্ঘনের মধ্যে পড়বে।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন