শনিবার, ২৩ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ১১:৪৮ পিএম

বুকভরা অভিমান নিয়ে চলে গেলেন  সাংবাদিক বিভুরঞ্জন

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: আগস্ট ২২, ২০২৫, ১১:৪৮ পিএম

বুকভরা অভিমান নিয়ে চলে গেলেন  সাংবাদিক বিভুরঞ্জন

নিখোঁজ হওয়ার এক দিন পর সাংবাদিক ও কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকারের লাশ গতকাল শুক্রবার বিকেলে মুন্সীগঞ্জের মেঘনা নদী থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ৭১ বছর বয়সি বিভুরঞ্জন আজকের পত্রিকার জ্যেষ্ঠ সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার কথা বলে বেরোনোর পর থেকে নিখোঁজ ছিলেন তিনি।

নিখোঁজের আগে কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে ‘খোলা চিঠি’ শিরোনামে একটা কলাম পাঠিয়েছিলেন। এই কলামে তিনি নিজের ও ছেলের অসুস্থতা, মেডিকেল পাস, সরকারি কর্মকর্তা মেয়ের উচ্চতর পরীক্ষায় ‘ফেল করা’,  বুয়েট থেকে পাস করা ছেলের ‘চাকরি না হওয়া’ এবং নিজের আর্থিক দৈন্য নিয়ে হতাশার কথা লিখেছেন। এ ছাড়া একটি কলাম প্রকাশ নিয়ে চাপের কথাও বলেছেন তিনি। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, বিভুরঞ্জন সরকার আত্মহত্যা করেছেন। তবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ এখনো নিশ্চিত করে কিছু বলেনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে সহকর্মী ও পরিচিতজনদের মাঝে। 

নারায়ণগঞ্জের কলাগাছিয়া নৌ পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (পরিদর্শক) সালেহ আহমেদ পাঠান জানান, শুক্রবার (গতকাল) বিকেলে কলাগাছিয়া এলাকায় মেঘনা নদীতে ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তির লাশ ভাসতে দেখা যায়। নৌ পুলিশ লাশ উদ্ধারের পর রমনা থানা এলাকা থেকে নিখোঁজ সাংবাদিকের ছবির সঙ্গে মিল পায়। রমনা থানায় করা জিডির সঙ্গে বিভুরঞ্জনের যে ছবিটি পরিবার দিয়েছিল, তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখার পর বিষয়টি রমনা থানাকে জানায় মুন্সীগঞ্জের পুলিশ।

নৌ পুলিশের নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলের পুলিশ সুপার আলমগীর হোসেন জানান, মৃতদেহ দেখে ধারণা করা হচ্ছে, এক দিন আগে তার মৃত্যু হয়। মৃতদেহ কিছুটা বিকৃত হতে শুরু করেছে। দেহে আঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। ময়নাতদন্তের পর মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে।

জানতে চাইলে পুলিশের রমনা বিভাগের উপকমিশনার মাসুদ আলম বলেন, মেঘনা নদীতে লাশ পাওয়া গেছে। তার পরিবার শনাক্ত করার পর আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়েছে।

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত বৃহস্পতিবার সকালে বাসা থেকে বের হন বিভুরঞ্জন। মোবাইল ফোনটিও তিনি বাসায় রেখে গিয়েছিলেন। তিনি না ফেরায় এবং কারো কাছে তার কোনো তথ্য না পাওয়ায় সেদিন রাতে রমনা থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন তার ছেলে ঋত সরকার। সেখানে তিনি বলেন, প্রতিদিনের মতো বৃহস্পতিবার সকাল ১০টায় সিদ্ধেশ্বরীর বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য রওনা দেন তার বাবা। কিন্তু এরপর আর বাসায় ফেরেননি।

বিভুরঞ্জন সরকারের জন্ম ১৯৫৪ সালে। ষাটের দশকের শেষদিকে পঞ্চগড়ে স্কুলছাত্র থাকাকালেই দৈনিক আজাদের মফস্বল সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতায় তার হাতে খড়ি। লেখাপড়া শেষ করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক ও সাপ্তাহিকে কাজ করেছেন। দৈনিক মাতৃভূমি, সাপ্তাহিক চলতি পত্রের সম্পাদক এবং সাপ্তাহিক মৃদুভাষণের নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। আশির দশকে এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে ‘তারিখ ইব্রাহিম’ ছদ্মনামে লেখা তার রাজনৈতিক নিবন্ধ পাঠকপ্রিয় হয়েছিল।

বিভুরঞ্জন সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। তবে পেশার কারণে তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না।

বিভুরঞ্জন সরকারের নিরুদ্দেশ হওয়ার পর তা নিয়ে আলোচনার মধ্যে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ৯টায় তার একটি ‘খোলা চিঠি’ তাদের মেইলে আসার কথা জানিয়ে গতকাল শুক্রবার তা প্রকাশ করে। ওই চিঠির ফুটনোটে তিনি লিখেছিলেন, ‘জীবনের শেষ লেখা হিসেবে এটা ছাপতে পারেন।’

বিভুরঞ্জন সরকার সেই চিঠিতে দীর্ঘ সাংবাদিকতাজীবনে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকার কথা লিখেছেন। তার ভাষ্যে, ‘আমার জীবনে কোনও সাফল্যের গল্প নেই। সাংবাদিক হিসেবেও এডাল-ওডাল করে কোনও শক্ত ডাল ধরতে পারিনি। আমার কোথাও না কোথাও বড় ঘাটতি আছে। এই ঘাটতি আর কাটিয়ে ওঠা হলো না।’

সাংবাদিকতার পাশাপাশি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে যান বিভুরঞ্জন সরকার। তবে এ নিয়েও নিজের হতাশার কথা লিখে যান শেষ চিঠিতে- ‘দৈনিক জনকণ্ঠ যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, তখন প্রথম পৃষ্ঠায় আমার লেখা মন্তব্য প্রতিবেদন ছাপা হতো। অথচ এখন কোনও কোনও পত্রিকায় লেখা পাঠিয়ে ছাপার জন্য অনুরোধ করেও ফল পাই না। আমার লেখা নাকি পাঠক আর সেভাবে খায় না। একসময় কত খ্যাতিমান লোকেরা আমার লেখা পড়ে ফোন করে তারিফ করেছেন।’

আর্থিক টানাপোড়েন নিয়ে বিভুরঞ্জন লিখেছেন, ‘এখন আমার দৈনন্দিন জীবন শুরু হয় ওষুধ খেয়ে, স্বাস্থ্য পরীক্ষা দিয়ে এবং ওষুধ কেনার টাকার চিন্তায়।’

নিজের কারণে সন্তানদেরও বিপাকে পড়তে হয়েছে বলে ধারণার কথা লিখে গেছেন তিনি- ‘আমার সংসারে স্ত্রী ছাড়া দুই সন্তান। এক মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে-মেয়েরাও আমার মতো একটু বোকাসোকা। বর্তমান সময়ের সঙ্গে বেমানান।’

পাঁচ দশকের সাংবাদিকতা জীবনে সত্য প্রকাশে ঝুঁকি নেওয়ার কথা লিখে গেছেন বিভুরঞ্জন সরকার। সেই সঙ্গে বলেছেন, এ জন্য কখনো সরকারি কোনো সুবিধা তিনি নেননি। তিনি লিখেছেন, ‘‘শুধু মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে অবিচল অবস্থানের কারণে আমাকে আজও ‘আওয়ামী ট্যাগ’ দেওয়া হয়। কিন্তু আওয়ামী আমলেও কোনও বাস্তব পুরস্কার পাইনি। আমি পেলাম না একটি প্লট, না একটি ভালো চাকরি। বরং দীর্ঘ সময় চাকরিহীন থেকে ঋণের বোঝা বেড়েছে। স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে পরিবারের দায়বদ্ধতা আমাকে প্রতিনিয়ত চাপের মধ্যে রাখে।’

বিভুরঞ্জন লিখেছেন, ‘রাজনৈতিক আদর্শবোধ ও সাংবাদিকতার নৈতিক সততা আমাকে ব্যক্তিগত সুখভোগের জন্য তাড়িত করেনি। একটাই তাড়নাÑ দায়িত্ববোধ। আমি জ্ঞানত কখনও দায়িত্ব পালনে অবহেলা করিনি। নিজের কাজে ফাঁকি দিইনি। খুব সাহসী মানুষ হয়তো আমি নই, কিন্তু চোখ রাঙিয়ে কেউ আমাকে দিয়ে কিছু লেখাতে পারিনি। অনেকেই সুবিধা, স্বার্থ, সামাজিক মর্যাদা বা আর্থিক স্বার্থের জন্য সত্যকে আড়াল করে লেখেন। আমি নাম আড়াল করলেও সত্য গোপন করিনি। তাই হয়তো দীর্ঘ পাঁচ দশকের বেশি সময় এই পেশায় কাটিয়ে সম্মানজনক বেতন-ভাতা পাই না।’

একটি কলাম ছাপানোর কারণে চাপে পড়ার কথা লিখে গেছেন বিভুরঞ্জন। তার ভাষ্য, ‘আমি লিখি, কারণ আমি জানতাম সাংবাদিকতা মানে সাহস। সত্য প্রকাশ মানে জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার নাম। দীর্ঘ পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা বলছে, সত্য লিখতে হলে কখনও কখনও ব্যক্তিগত স্বাচ্ছন্দ্য হারাতে হয়। আমি তেমন স্বাচ্ছন্দ্য চাইনি কখনও। তবে সারা জীবন হাত পেতে চলতে হবে, এটাও চাইনি’Ñবলে গেছেন তিনি।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!