ঢাকা সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

তুচ্ছ ঘটনায় রণক্ষেত্র চবি, আহত ৫ শতাধিক

চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০২:৫০ এএম
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং জোবরা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে গ্রামবাসীসহ ৫ শতাধিক শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। এর মধ্যে গতকাল রোববার সন্ধ্যা পর্যন্ত সাড়ে ৩ শতাধিক আহত শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের মেডিকেলে। এ ছাড়া শতাধিক আহতকে ভর্তি করানো হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে, ৫০ জনের অধিক নগরীর পার্কভিউ হাসপাতালে এবং ২৫ শিক্ষার্থী চিকিৎসাধীন রয়েছেন নগরীর ন্যাশনাল হাসপাতালে। এর মধ্যে কারও মাথায় আঘাত, কারও ভেঙেছে হাত। তাদের মধ্যে ২০ জনের অবস্থা আশঙ্কজনক। আহতদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিন, প্রক্টর অধ্যাপক তানভীর মোহাম্মদ হায়দার আরিফসহ কয়েকজন সাংবাদিকও আছেন। পরিস্থিতি সামলাতে এরই মধ্যে চবি এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করেছে প্রশাসন। গতকাল বিকেল ৪টার দিকে পুলিশ-র‌্যাব ও সেনাবাহিনী যৌথ অভিযান শুরু করেছে চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় এলাকায়। 

এদিকে উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিনের দাবি, গ্রামবাসীর ভেতরে ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা ঢুকে গিয়ে এই হামলা চালিয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে পুলিশের দুটি, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর একটি ও প্রক্টরিয়াল বডির একটি গাড়ি ভাঙচুর করে স্থানীয়রা। ঘটনাস্থলে থাকা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতা, চবি শিক্ষার্থীর তালাত মাহমুদ রাফির অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের ওপর দফায় দফায় হামলা চালানোর পরও নীরব ভূমিকা পালন করেছে পুলিশ। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বারবার জানানোর পরও পুলিশের কাছ থেকে সহযোগিতা পাচ্ছি না। গত শনিবার থেকে শুরু হয়ে দুই পক্ষের মধ্যে এই সংঘর্ষ গতকাল এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত দফায় দফায় চলছিল। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গ্রামবাসীর হামলার শিকার হয়েছেন দ্য ডেইলি স্টারের স্টাফ রিপোর্টার সেফায়েত উল্লাহ, আরটিভির ক্যামেরাপারসন ইমু খান, দেশ টিভির ক্যামেরাপারসন হাসান মিয়া, রিপোর্টার মোহাম্মদ নাজিম।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত শনিবার দিনগত রাতে চবির ২ নম্বর গেট এলাকার বাসার সামনে সংঘাতের সূত্রপাত হয়। ওই বাসায় এক নারী শিক্ষার্থী ভাড়া থাকেন। রাত সাড়ে ১১টার দিকে তিনি বাসায় ফিরলে দারোয়ান গেট খুলতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে ওই শিক্ষার্থী ও দারোয়ানের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হয়। একপর্যায়ে ছাত্রীকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন দারোয়ান।

এরপর ছাত্রী তার সহপাঠীদের খবর দিলে তারা সেখানে গিয়ে দারোয়ানকে চড়-থাপ্পড় দেন। শিক্ষার্থী লাঞ্ছনার বিষয়টি ক্যাম্পাসে দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে সেখানে শিক্ষার্থীরা জড়ো হতে থাকেন। এই সময় শিক্ষার্থীরা দারোয়ানকে খুঁজতে গেলে স্থানীয়রা ইটপাটকেল ছুড়তে শুরু করেন। একপর্যায়ে দুই পক্ষের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ বাধে।

ভুক্তভোগী ছাত্রীর নাম সাফিয়া খাতুন। জানতে চাইলে গণমাধ্যমকর্মীদের তিনি বলেন, গেটে অনেকক্ষণ ধাক্কা দেওয়ার পরও খোলা হয়নি। পরে গেট খুলে আমাকে মারধর করা হয়। এরপর আমি সহপাঠীদের খবর দিলে তারা সেখানে জড়ো হয়ে প্রতিবাদ করে। এ সময় স্থানীয় লোকজন আমাদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। 

তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, রাত ১১টার মধ্যে ঘরে ঢোকার নিয়ম থাকলেও এই শিক্ষার্থী রাত ১২টার দিকে ঘরে ঢোকার জন্য গেটে নক করেন। এত রাতে ঘরে ঢুকতে দেওয়া মালিকের নিষেধ আছে জানালে দারোয়ানের সাথে ওই নারী শিক্ষার্থীর কথা-কাটাকাটি হয়।   

চবির শিক্ষার্থী মোহাম্মদ হাসান বলেন, মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর স্থানীয়রা হামলা করে। শিক্ষার্থীদের যেখানেই পেয়েছে, সেখানে দা দিয়ে কুপিয়ে জখম করেছে। 

সূত্র বলছে, রোববার সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা প্রশাসনের একটি প্রতিনিধিদল ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্রামবাসীর সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। এ সময় উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মো. কামাল উদ্দিনের ওপর হামলা চালায় স্থানীয়রা।

হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মুমিন বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে হাটহাজারী উপজেলাধীন ফতেপুর ইউনিয়নের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ২নং গেট বাজারের পূর্ব সীমা থেকে পূর্ব দিকে রেলগেট পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে রোববার দুপুর ২টা থেকে সোমাবার রাত ১২টা পর্যন্ত ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। 

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, বিকেল ৪টার দিকে ২ নম্বর গেটের সড়ক দিয়ে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও র‌্যাবের ২০টি গাড়ি প্রবেশ করে জোবরা গ্রামের দিকে যায়। তাদের পেছন পেছন শিক্ষার্থীরাও যান। দেরিতে ঘটনাস্থলে আসায় ভুয়া ভুয়া বলে দুয়োধ্বনি দেন শিক্ষার্থীরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের তৃতীয় শিক্ষার্থী মো. আসিফ বলেন, সকালের দিকে সেনাবাহিনী এসে ফিরে গেছে। এরপর আর আসেনি। বিকেল চারটার দিকে এসেছে। সকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ঘটনাস্থলে থাকলে এতবড় ঘটনা ঘটত না।

কারও মাথায় আঘাত, কারও ভেঙেছে হাত: কারও মাথায় ব্যান্ডেজ, কারও হাতে। স্ট্রেচারে আনা হচ্ছিল আহত শিক্ষার্থীদের। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) ক্যাজুয়ালটি ওয়ার্ডের সামনে ছিল শিক্ষার্থীদের ভিড়। আহত সহপাঠীদের নিয়ে ২০ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাস থেকে এসেছেন তারা। বিকেল পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষার্থীকে চমেকে আনা হয়েছে বলে জানান তারা।

চমেক হাসপাতালে আসা শিক্ষার্থীরা জানান, গতকাল রোববার বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ নম্বর গেটে জোবরা গ্রামের স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুরো ক্যাম্পাসে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলে অনেক আহত শিক্ষার্থীদের নেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে গুরুতর আহত শিক্ষার্থীদের পাঠানো হয়েছে চমেক হাসপাতালে। আহত শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগ মাথা, হাত ও পায়ে আঘাত পেয়েছেন। বেশির ভাগ আহত শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়েছে ক্যাজুয়ালটি বিভাগে। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেখান থেকে তাদের বিভিন্ন ওয়ার্ডে পাঠানো হচ্ছে।

চবি সংঘর্ষে উসকানিতে পদ হারালেন বিএনপি নেতা: এদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয়দের সংঘর্ষের ঘটনায় উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য উদয় কুসুম বড়ুয়াকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। গতকাল সকালে নিজের ফেসবুক পোস্টে চবি শিক্ষার্থীদের ‘সন্ত্রাসী’ আখ্যা দেন উদয় কুসুম বড়ুয়া। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে সংঘর্ষে ইন্ধন দেওয়ার অভিযোগও উঠেছে।

এরপর বিকেলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভীর স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দলের নির্দেশনা অমান্য করে সংগঠনবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকার পাশাপাশি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে উদয় কুসুম বড়ুয়াকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার করা হলো।