ঢাকা সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গাজীপুর সিটির ২২ বস্তিতে 

সবজির মতো সর্বত্র মাদক

জহিরুল ইসলাম, গাজীপুর
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০২:৫৬ এএম
গাজীপুর সিটির বস্তি
  • অধিকাংশেরই নিয়ন্ত্রণ নারী কারবারিদের হাতে
  • এক বছরে ৩৫০ মামলায় ৩৮৬ জন আসামি
  • গাজীপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জনবল মাত্র ২২ জন
  • মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যান
  • মাশোহারার ভাগ পায় পুলিশও 
  • মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যেন ঠুঁটো জগন্নাথ 


গাজীপুর সিটি করপোরেশনের বস্তিগুলোতে মাদকের ব্যবসা এখন জমজমাট। নগরীর ২২ বস্তি ঘিরে গড়ে উঠেছে শতকোটি টাকার মাদকের ব্যবসা। সূত্র জানায়, এ ব্যবসায় কারবারিই আছেন প্রায় পাঁচ শতাধিক। অভিযোগ রয়েছে, তারা স্থানীয় রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় এবং পুলিশকে ভাগ দিয়ে দেদার চালিয়ে যাচ্ছে মাদকের ব্যবসা। সম্প্রতি পুলিশের অভ্যন্তরীণ গোপন প্রতিবেদনেও পুলিশের পকেটে মাদক ব্যবসার টাকার ভাগ যায় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বিভিন্ন অভিযানে মাদকের বাহকরা গ্রেপ্তার হলেও বড় কারবারি ও মূল হোতারা রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরে মেট্রোপলিটনে জনবল রয়েছে অন্তত এগারোশ। এর বিপরীতে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের জনবল মাত্র ২২ জন। অভিযানের জন্য রয়েছে মাত্র একটি গাড়ি। ফলে মাদকবিরোধী অভিযানে সফল হতে পারছে না অধিদপ্তর। জনবল সংকট, যুগোপযোগী পদ্ধতির অভাব এবং সশস্ত্র মাদক কারবারিদের কাছে অসহায় হয়ে পড়ছে সংস্থাটি। 

তবে গাজীপুর জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরে গত এক বছরের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বল্প জনবল নিয়েও তারা গত এক বছরে (২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত) ১ হাজার ২২৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে। মোট ৩৫০টি মামলায় ৩৮৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।  অনুসন্ধানে জানা যায়, সিটি করপোরেশনের টঙ্গী এলাকার হাজী মাজার বস্তি, কড়ইতলা বস্তি, কলাবাগান বস্তি, জিন্নাত মহল বস্তি, নিশাত মহল বস্তি, লাল মসজিদের পেছনের বস্তি, নামার মাজার বস্তি, ব্যাংকের মাঠ, মিল বেরাক বস্তি, টঙ্গী স্টেশন বস্তি, এরশাদ নগর বস্তি, গাছা বস্তি, লক্ষীপুরা, শিববাড়ি, জয়দেবপুর রেলগেট-কাজীবাড়ি বস্তি, ভরান, কোনাবাড়ী বস্তি, ভোগড়া বস্তি, টঙ্গী বোর্ডবাজার বস্তি, সালনা বস্তি, পূবাইল ও কাশিমপুর বস্তিতে ছোট ছোট ঝুপরি ঘর ঘিরে রয়েছে মাদকের বিশাল হাট। 

বস্তির এসব হাটের অধিকাংশই নিয়ন্ত্রণে রয়েছেন নারীরা। তারা অনেকেই মাদক ব্যবসার লাভের টাকায় স্বামীকে কিনে দিয়েছেন প্রাইভেট কার, ট্রাক, অটোরিকশা। অনেকে কিনেছে বাড়ি-ফ্ল্যাট। নামে-বেনামে করেছেন বিপুল সম্পদ। তবে অভিযানে মাঝেমধ্যে ছোট ব্যবসায়ীরা গ্রেপ্তার হলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে যান। গ্রেপ্তার হলেও জামিনে বের হয়ে ফের মাদক কারবারে যুক্ত হচ্ছেন তারা। 

জানা যায়, গত বছরের ৫ আগস্টের পর মাদকের কারবার বেড়েছে বহুগুণ। শাক-সবজির মতো যত্রতত্র পাওয়া যায় মাদক। ফলে তরুণ মাদকাসক্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ইয়াবাসহ বিভিন্ন মাদকে আসক্ত সন্তানের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ পরিবারের লোকজন। অবস্থা এমন বেগতিক যে, আসক্তরা মাদকের টাকা জোগাড়ের জন্য নিজের মা-বাবাকে শারীরিক-মানসিকভাবে নির্যাতন করছে। আবার মাদকের অর্থ জোগাতে চুরি-ছিনতাইসহ নানা অপরাধে জড়াচ্ছে তারা। 

অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, নগরীর মাদক কারবারের রাজধানী টঙ্গী। টঙ্গীর বিভিন্ন বস্তি ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রধান প্রধান মাদকের হাট। যৌথ বাহিনী কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে শতাধিক মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করলেও বন্ধ হয়নি ব্যবসা। টঙ্গীর আলোচিত নারী মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে রয়েছেন ব্যাংক মাঠ বস্তির মোমেলা বেগম, ময়না বেগম ও আফরিনা বেগম।

একটি সূত্র জানায়, আফরিনা বেগমই টঙ্গীর বস্তিগুলো থেকে মাদকের টাকা তুলে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে ম্যানেজ করে। তারা সবাই কোটিপতি। মোমেলা বেগম মাদক বিক্রির টাকায় টঙ্গীতে বাড়ি কিনেছেন তিনটি। ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের মরকুন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে কুদ্দুস খলিফা রোডে ‘জাহিদ হাসান ভিলা’ নামে বহুতল ভবনটির মালিকও তিনি। শিলমুন পূর্বপাড়া স্বপন মাস্টারের কাছ থেকে অর্ধকোটি টাকায় কেনেন আরও একটি বাড়ি। এ ছাড়াও পুবাইলের করমতলা পূর্বপাড়া আবাসিক এলাকায় পৌনে চার কাঠা জমিতে আরও একটি আধাপাকা বাড়ি রয়েছে তার। এ ছাড়া ব্যাংকের মাঠ বস্তিতে রয়েছে একাধিক আধাপাকা ঘর। সেখান থেকেই তিনি মূলত মাদক ব্যবসাটি নিয়ন্ত্রণ করেন।

মোমেলা তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে কিনে দিয়েছে চারটি মিনি ট্রাক ও অটোরিকশা। মেয়ের জামাই (কথিত পুলিশের সোর্স) হৃদয়কে কিনে দিয়েছে প্রাইভেট কার। এ ছাড়া টঙ্গী ও সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন এলাকায় মোমেলা মাদক ব্যবসার টাকায় নামে-বেনামে কয়েক কোটি টাকার সম্পত্তি কিনেছেন। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ১১ বছরে মোমেলার বিরুদ্ধে টঙ্গী পূর্ব থানাসহ বিভিন্ন থানায় ১৭টি মাদক মামলা দায়ের রয়েছে। 

অপর মাদক ব্যবসায়ী ময়না বেগমের হয়ে ব্যবসা করেন তার ভাই শফিকুল ইসলাম। তার নামে রয়েছে একাধিক মাদক মামলা। ময়না বেগমের মেয়ে নার্গিস আক্তার ছয়টি ও ছেলে তাজুল ইসলামও একাধিক মাদক মামলার আসামি। ময়না ও তাজুল মাদকের টাকায় আত্মীয়স্বজন ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নামে গাজীপুর ও মাদারীপুরে গড়েছে বাড়ি, ফ্ল্যাটসহ বিপুল সম্পদ। আরেক মাদকসম্রাজ্ঞী রানী বেগম ও তার ছেলে রাব্বানি ছাড়াও কারবারি রিপন মিয়া, টুক্কু, রতœা, কানা আমির ও মৃদুলসহ শতাধিক কারবারি টঙ্গীর মাদকের হাট নিয়ন্ত্রণ করছে বলে জানা যায়।

গাজীপুর সদর থানায় সবচেয়ে বড় মাদকের হাট ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের লক্ষ্মীপুরায়। সেখানে দেড় দশক আগে শূন্য হাতে ঢাকার ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টারসংলগ্ন চাঁনপাড়া বস্তি থেকে এসে ঘাঁটি গেড়েছিল তাহমিনা আক্তার। পরে হয়ে ওঠে মাদকসম্রাজ্ঞী। তার স্বামী জুলহাস। তাহমিনা গাজীপুর মহানগরের বড় হেরোইন ও ইয়াবার ডিলার। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে মাদক ব্যবসায় জড়িত। মাদকের টাকায় তারা এলাকায় গড়েছে চারতলা বাড়ি। তাহমিনার বিরুদ্ধে হেরোইন, ইয়াবা, ফেনসিডিল ও গাঁজা ব্যবসার অভিযোগে সাতটি মামলা রয়েছে। তার ছেলে জুয়েলের সঙ্গে সখ্য ছিল স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের। এসব নেতার প্রশ্রয়ে পুরো পরিবার মাদক ব্যবসায় বেপরোয়া হয়ে ওঠে। 

লক্ষ্মীপুরা এলাকায় মাদক ব্যবসা করে কোটিপতি হয়েছে হারুন ও তার স্ত্রী আশা। তাদের বিরুদ্ধে ডজনখানেক মাদক মামলা রয়েছে সদর ও বাসনসহ বিভিন্ন থানায়। হারুনের ছেলে যুবলীগ কর্মী মিনহাজুল ছিলেন পুলিশের সোর্স। নিয়মিত পুলিশকে মাসোয়ারা দিয়ে ব্যবসা চালিয়েছেন তিনি। মাদকের টাকায় এলাকায় গড়েছেন বহুতল বাড়ি। 

টঙ্গীর আলোচিত ভরান মাজার বস্তি মাদক হাটের একক নিয়ন্ত্রণ এখন শাহাবউদ্দিন ওরফে দাবারুর হাতে। টঙ্গীসহ বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে রয়েছে সাতটি মাদক মামলা। এর মধ্যে একটি মামলায় তিনি ৩৫ বছরের সাজাপ্রাপ্ত। তার বাড়ি জামালপুর জেলার ইসলামপুরের আইরমারী গ্রামে। শাহাবউদ্দিন একসময় এ বস্তির শীর্ষ মাদক কারবারি বাচ্চুর ‘ডান হাত’ ছিলেন। ২০১৮ সালের মে মাসে র‌্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে বাচ্চু নিহত হলে টঙ্গী ত্যাগ করেছিল দাবারু। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে বস্তিতে ফেরেন তিনি। রবিউল ইসলাম ওরফে কিং বাবু ও নূর মোহাম্মদকে সঙ্গে নিয়ে সেখানকার মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেন। স্থানীয় টিভিএস হোন্ডা সড়কে অফিস খুলেছেন তিনি। ক্ষমতার জোরে বস্তিতে জমি দখল করে ছোট ছোট দোকান ও ঘর তৈরি করে ভাড়া নিচ্ছেন। বস্তির কয়েকজন বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে রূপালি বাংলাদেশকে বলেন, শাহাবউদ্দিন হেরোইন, ইয়াবা, মদ, গাঁজা, ফেনসিডিলসহ সব ধরনের মাদকের পাইকারি ডিলার। বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে বারবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও শাহাবউদ্দিনের মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। এ ছাড়াও সিটি করপোরেশনের ২৪নং ওয়ার্ডের পশ্চিম চতর এলাকায় মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করে শামী ওরফে মুরগি শামীম। তার রয়েছে অর্ধশত খুচরা বিক্রেতার একটি বড় গ্রুপ। গত ১০ বছরের মাদকের টাকায় গড়েছেন তিনি একাধিক বাড়ি।

পুলিশ জানায়, মহানগরের কোনাবাড়ী, কাশিমপুর, বোর্ডবাজার, ভোগড়া, সালনা ও পুবাইলে রয়েছে মাদকের পাইকারি হাট। এ ছাড়াও সিটির অলিগলিতে চলছে রমরমা মাদক ব্যবসা। একটি সূত্র জানায়, বস্তিগুলোয় দিনে কমপক্ষে কয়েক কোটি টাকার মাদক বেচাকেনা হচ্ছে।

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় ও পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তার হলেও বহু কারবারি জামিনে বের হয়ে আবার এ কারবারে যুক্ত হচ্ছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গাজীপুর জেলার উপপরিচালক এমদাদুল ইসলাম মিঠুন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এসব বস্তিতে ভাসমান যারা আছেন তারাই মূলত মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া কিছু কিছু বস্তিতে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা অধিপত্য বিস্তার করে মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। চেষ্টা করছি মাদক নির্মূল করার জন্য। বস্তিগুলোয় নিয়মিত অভিযান চলমান, ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। বস্তিগুলো সরকারি খাস জমিতে বিভিন্নভাবে তারা দখল করে বাস করছে। যদি বস্তিগুলোকে উচ্ছেদ করা যায় তাহলে মাদক নির্মুল করা সম্ভব হবে। 
এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বস্তিতে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা তাদের প্রশ্রয় না পেলে কি মাদক ব্যবসা করা সম্ভব? কেউ না কেউ তাদের এই বস্তিগুলো ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছে। তিনি বলেন, গত এক বছরে আমরা মাদকের বিরুদ্ধে ১২২৪টি অভিযান পরিচালনা করেছি। এরমধ্যে ৩৫০টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩৮৬ জনকে। এসব মামলার মধ্যে ১৫৭টি নিয়মিত মামলা এবং ১৯৩টি মোবাইল কোর্টের মামলা। 

জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছরে বিভিন্ন অভিযান চালিয়ে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬৩৪ পিস ইয়াবা, ২৬৭ কেজি গাঁজা, ৩৩৫ লিটার চোলাইমদ, ৩ হাজার ৫০ লিটার ওয়াশ, ২৫১ বোতল ফেনসিডিল, ৪৬ ক্যান বিয়ার, ১.৩৩৯ কেজি হেরোইনসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় ইনজেকশনসহ বিভিন্ন ধরনের মাদক ও মাদক বিক্রির টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর গাজীপুরের সহকারী পরিচালক শাহীন মাহমুদ বলেন, আমরা ইতিমধ্যে বেশকিছু অভিযান পরিচালনা করেছি। তবে সামাজিক সচেতনতা ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা গেলে মাদক নির্মূল করা সহজ হবে। এ বিষয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশর কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খানের মোবাইলে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।