কোটি কোটি টাকা ব্যাংকে এফডিআর করে রাখেন। সারা বছর সেই এফডিআর থেকে মুনাফা তোলেন। ঠিক জুন মাসের শেষে এফডিআর ভেঙে ‘ইন্টারেস্টসহ’ পুরো টাকা নগদায়ন করে ৩০ জুন ‘ব্যালেন্স’ শূন্য করেন। ব্যাংকে ‘ব্যালেন্স শূন্য’ বা টাকা নেই দেখিয়ে আয়কর শূন্য রিটার্ন জমা দেন। অর্থাৎ আয় নেই, তাই করও দেন না। এভাবে চলে ৬ বছর।
তবে ঠিক ৩০ জুনের পর কোনো একসময় সেই টাকা আবার ‘এফডিআর’ করেন। শুধু নিজের নয়, সঙ্গে স্ত্রীর নামেও এফডিআর করেন এবং ৩০ জুনের আগে ভেঙে ফেলেন। ‘ব্যালেন্স শূন্য’ দেখিয়ে কর দেন না এই আয়কর আইনজীবী নিরঞ্জন ঘোষ।
তার গ্রামের বাড়ি মানিকগঞ্জ সদরের বালিরটেক। থাকেন ঢাকার সিদ্ধেশ্বরীতে। আইনজীবী হয়েও কর ফাঁকি দিয়েছেন সাড়ে তিন কোটি টাকা। তবে জরিমানাসহ তা প্রায় চার কোটি টাকা হবে। আয়কর গোয়েন্দার চলমান অনুসন্ধানের কর ফাঁকির সেই কপি এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয়কর বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কর ফাঁকির প্রতিনিয়ত নতুন কৌশল আমরা জানতে পারছি। তবে ৩০ জুনের আগেই ‘ব্যালেন্স’ শূন্য করা। সেই শূন্য ব্যালেন্স দেখিয়ে রিটার্ন দেওয়ার তথ্য নতুন কৌশল। একজন আইনজীবীর কাছে এমন কৌশল আশা করা যায় না।
আয়কর গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ ও তার স্ত্রী অন্তরা ঘোষের সর্বশেষ ২০২৪-২৫ করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করা হয়। সেখানে দেখা যায়, করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ ২০২৪-২৫ করবর্ষে নামমাত্র ব্যক্তিগত আয় দেখিয়েছেন। এ ছাড়া মৎস্য খাত (মৎস্য আয়ের প্রমাণপত্র নেই) ও ব্যবসা থেকেও নামমাত্র আয় দেখিয়েছেন। তবে তিনি ৩ কোটি ১৩ লাখ টাকার নিট সম্পদ দেখিয়েছেন। নামমাত্র আয় দেখানো ও ব্যাংক হিসাবের ব্যালেন্স ‘শূন্য’ দেখানোর ফলে গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সন্দেহ হয়। অনুসন্ধানে নেমে প্রথমে দুই করদাতার ব্যাংক তল্লাশি করলে চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসে। তবে অনুসন্ধান চলমান বলেন তারা।
প্রাথমিক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ চলতি বছরের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে সাউথইস্ট ব্যাংক কাকরাইল শাখায় চারটি এফডিআর ভেঙে ইন্টারেস্টসহ ৭ কোটি ৪৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার নেন। এতে তার ব্যালেন্স শূন্য হয়ে যায়। এ ছাড়া মার্কেন্টাইল ব্যাংকের একটি শাখায় এফডিআর ভেঙে ইন্টারেস্টসহ এক কোটি ৩৫ লাখ টাকার পে-অর্ডার নেন। এই দুই ব্যাংক থেকে মোট প্রায় ৮ কোটি ৮০ লাখ টাকার পে-অর্ডার নিয়েছেন এই করদাতা। কিন্তু তিনি সর্বশেষ করবর্ষের রিটার্নে এই এফডিআর করা ও ভেঙে ফেলার বিষয় উল্লেখ করেননি।
অনুসন্ধানে কর্মকর্তারা আরও পেয়েছেন, ৭ জুলাই করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ সাউথইস্ট ব্যাংক করপোরেট শাখায় ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার ১২টি এফডিআর করেন। অর্থাৎ সাউথইস্ট ব্যাংক কাকরাইল শাখা ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকে জুনের শেষ সপ্তাহে এফডিআর ভাঙিয়ে নেওয়া পে-অর্ডারের টাকার সঙ্গে আরও প্রায় ২ কোটি ৩৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা যোগ করে মোট ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার টাকার নতুন করে এফডিআর করেন। অথচ রিটার্নের সঙ্গে জমা দেওয়া ব্যাংক হিসাবের ব্যালেন্স শূন্য দেখিয়েছেন।
তথ্য বলছে, মোট ১১ কোটি ১৪ লাখ ৯২ হাজার টাকা রিটার্নে দেখাননি করদাতা নিরঞ্জন সাহা। যা আয়কর আইন অনুযায়ী অপ্রদর্শিত আয় হিসেবে গণ্য করা যায়। প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, এর ওপর ২৫ শতাংশ হারে প্রযোজ্য কর হবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা। তবে জরিমানাসহ তা প্রায় চার কোটি টাকা হবে। যা এই করদাতা ফাঁকি দিয়েছেন বলে ধারণা করছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। এ ছাড়া করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ রিটার্নে যে মৎস্য আয় দেখিয়েছেন, তার সপক্ষে কোনো প্রমাণাদি নেই।
অনুসন্ধানে আরও দেখা গেছে, শুধু ২০২৪-২৫ করবর্ষ নয়, করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ ও তার স্ত্রী অন্তরা ঘোষ একইভাবে ২০১৯-২০, ২০২০-২১, ২০২১-২২, ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ করবর্ষেও একইভাবে ব্যাংক হিসাবের ব্যালেন্স শূন্য দেখিয়ে আসছেন। এই ছয় করবর্ষের রিটার্ন যাচাই করা হচ্ছে। এ ছাড়া ব্যাংক থেকে এই দুই করদাতার আরও তথ্য সংগ্রহ করতে ব্যাংকে চিঠি দেওয়া হয়েছে এবং এই দুই করদাতার সব ব্যাংক হিসাব স্থগিত (ফ্রিজ) করা হয়েছে।
করদাতা নিরঞ্জন ঘোষের খিলগাঁও এলাকায় এএএ প্লাস এক্সেসরিজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ করবর্ষে নিরঞ্জন ঘোষ এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে আয় দেখিয়েছেন প্রায় ৭ লাখ ৭৩ হাজার টাকা। এই করদাতার অন্যান্য আয়, ব্যাংকের তথ্য ও কী পরিমাণ সম্পদ রয়েছে-তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
অভিযুক্ত করদাতা নিরঞ্জন ঘোষ অফিস নিয়েছেন ঢাকার কাকরাইলে। সেখানে গিয়ে তাকে না পাওয়া যাওয়ায় ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। তবে তার হয়ে কথা বলেন তার জুনিয়র সুবল দেবনাথ। তিনি বলেন, ‘নিরঞ্জন ঘোষ অসুস্থ, কারো সঙ্গে কথা বলতে পারছেন না। এ বিষয়ে কর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান রাকিব স্যারের সঙ্গে কথা হয়েছে, কিছু টাকাও জমা দিয়ে এসেছি। গত রোববার কথা হলে তিনি কোনো সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করেছেন।’
আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের কমিশনার মোহাম্মদ আবদুর রকিব বলেন, রিটার্নে এফডিআর দেখানো নেই। ৩০ জুনের পর আবার সেই টাকা এফডিআর করা হয়। রিটার্নে ব্যালেন্স শূন্য দেখিয়ে কর ফাঁকি দিতে এই নব কৌশলের আশ্রয় নিয়েছেন একজন আইনজীবী। একজন আইনজীবীর কাছে আমরা এমন আশা করতে পারি না।’
নতুন কৌশল বন্ধের সুপারিশ সম্পর্কে এনবিআরের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বছর থেকে ই-রিটার্ন বাধ্যতামূলক হয়েছে। সেক্ষেত্রে কোনো করদাতা এমন করলে বিপদে পড়বেন। কারণ ওই করদাতার তথ্য ব্যাংক থেকে অটো যাচাই হবে। যেসব করদাতা এই অপকৌশলের আশ্রয় নেবেন, তারা জরিমানাসহ শাস্তির মুখোমুখি হবেন’।