*** এটা বিএমইউর অধীনে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান। কেন এটির উন্নয়ন হচ্ছে না, তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করা হবে: প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান
দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে অসংক্রামক নানা ধরনের রোগ। পাশাপাশি ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার মতো সংক্রামক রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে নিয়মিত। এসব রোগীর চিকিৎসাসেবা দিতে রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসকদের যখন নাভিশ^াস উঠছে, তখনো কোনো রোগী নেই রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র শাহবাগের বাংলাদেশ মেডিকেল ইউনিভার্সিটির (বিএমইউ) অধীনে পরিচালিত সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে। হাসপাতালটির উন্নয়নে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারও কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। এখনো বিএমইউর হাতেই রয়েছে পরিচালনার দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ নানা বিভাগ থেকে কয়েক দফা চেষ্টা করলেও পূর্ণাঙ্গ রূপ পাচ্ছে না হাসপাতালটি।
উদ্বোধনের তিন বছর পরও চিকিৎসকসহ সাধারণ পদগুলোতেও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে শুরুই হয়নি নিয়োগ কার্যক্রম। চাহিদা অনুযায়ী চিকিৎসক না থাকা, ল্যাব-যন্ত্রপাতি থাকলেও প্রয়োজনীয় টেকনেশিয়ান-কর্মী না থাকা এবং উচ্চ চিকিৎসা ফি’র কারণে হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়েছে রোগীরা। উদ্বোধনের পর এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা নিয়েছে মাত্র ৫০ হাজার রোগী। এ ছাড়া অন্যান্য হাসপাতালের বহির্বিভাগে যেখানে প্রতিদিন এক-দেড় হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়, সেখানে সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে রোগীরা সেবা পাচ্ছে না কেন, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে মানুষের মধ্যে। মানুষের জন্য সর্বাধুনিক স্বাস্থ্যসেবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গড়ে তোলা হলেও চিকিৎসক-রোগীর পদচারণা না থাকায় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতাল রীতিমতো সুপারফ্লপ হয়ে বর্তমানে ভূতুড়ে হাসপাতালে পরিণত হয়েছে। চিকিৎসাসেবার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি হলেও তা ব্যর্থ হতে চলেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
২০২২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর চিকিৎসাসেবার প্রস্তুতি ছাড়াই ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে হাসপাতালটি উদ্বোধন করেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই বছরের অক্টোবরে হাসপাতালের বহির্বিভাগ চালুর ঘোষণা দেন তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। অথচ তখনো হাসপাতালের সেবা পুরোপুরি চালু হয়নি, যা এখনো চলমান। হাসপাতালের সেবা পুরোপুরি চালু করতে ১ হাজার ৮০২ জন চিকিৎসক ও নার্সের প্রয়োজন। অথচ এখন পর্যন্ত নিয়োগ হয়েছেন মাত্র ৫৮৪ জন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, হাসপাতালের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় সামান্য কিছু রোগী ও চিকিৎসকের আনাগোনা থাকলেও অন্যান্য ফ্লোর প্রায়ই খালি থাকে। এসব ফ্লোরে উঠলে দিনের বেলায়ই গা ছমছম করে। চতুর্থ তলায় গিয়ে দেখা যায় দু-একজন নার্সের পোশাক পড়া ছাড়া আর কোনো জনমানব নেই। তবে নিচতলায় ফার্মেসি, ক্যান্টিন, দোতলায় বিশেষজ্ঞদের চেম্বারের সামনে কিছু রোগীর আনাগোনা রয়েছে।
বিএমইউর উত্তর পাশে ৩ দশমিক ৮ একর (প্রায় ১২ বিঘা) জমির ওপর গড়ে ওঠা এই হাসপাতালের মনোরম অবকাঠামো যেকোনো মানুষেরই দৃষ্টি কাড়বে। এই হাসপাতালে প্রতিদিন দিনে কমপক্ষে ৫ হাজার রোগীর সমাগম থাকার কথা থাকলেও রোগী হচ্ছে মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ জন। তাদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে স্থায়ী চিকিৎসক নেই একজনও। একই চিকিৎসক বিএমইউতে সকালে ৩০ টাকায় চিকিৎসা দিলেও সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালে তাকে দেখাতে গেলে দিতে হয় ১ হাজার টাকা। শুধু তাই নয়, বেশির ভাগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ না থাকায় চিকিৎসক এখানে দেখালেও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর জন্য রোগীকে বিএমইউর প্যাথলজি বিভাগেই যেতে হয়।
রোগীদের যাতে চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে না হয় এবং দেশেই যাতে রোগীরা লিভার, কিডনি, হার্টের রোগ, ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব, জয়েন্ট নী রিপ্লেসমেন্টসহ সব জটিল রোগের সর্বাধুনিক উন্নত চিকিৎসাসেবা পায়, সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল হাসপাতালটিতে। রয়েছে স্টেম সেল থেরাপি ও জিন থেরাপির ব্যবস্থাও। এ ছাড়া রোবোটিক সার্জারি চালু করারও ঘোষণা দেয় তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাস্তবতা এখনো ভিন্ন। হাসপাতালটিতে রয়েছে বিশ্বমানের এনআইসিইউ, পিআইসিইউ, আইসিইউসব ধরনের আইসিইউ ব্যবস্থা। এই হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগে রয়েছে ১৪টি অত্যাধুনিক অপারেশন থিয়েটার, ১০০ শয্যার আইসিইউ, জরুরি বিভাগে আছে ১০০ শয্যা, আছে ভিভিআইপি কেবিন ৬টি, ভিআইপি কেবিন ২২টি এবং ডিলাক্স শয্যা ২৫টি। সেন্টার-ভিত্তিক প্রতিটি ওয়ার্ডে স্থাপন করা হয়েছে আটটি করে শয্যা। হাসপাতালটিতে রয়েছে নিউম্যাটিক টিউব, যার মাধ্যমে রক্ত সংগ্রহের পর অটোমেটিক্যালি নির্দেশিত বিভাগে চলে যায়, যা সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হয়। কিন্তু কোনো বিভাগেই নিজস্ব জনবল না থাকায় প্রায় সব সেবাই ব্যাহত হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক কর্মকর্তা রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, হাসপাতালটি পরিচালনা করতে ১ হাজার ৮০০ জনের মতো জনবল প্রয়োজন। কিন্তু এখনো এর অর্ধেকও নিয়োগ হয়নি। হাসপাতালটির ভিআইপি কেবিন দূরে থাক, সাধারণ কেবিনেও কোনো রোগী নেই জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, বিএমইউতে একটা কেবিন পাওয়ার জন্য মানুষের হাহাকার লেগেই থাকে। প্রয়োজনে মন্ত্রী-এমপিরও সুপারিশ নিতে হয়। কিন্তু এখানে এতসব সুবিধা সত্ত্বেও রোগী আসছে না। এর একমাত্র কারণ জনবলের সংকট। জনবল নিয়োগ না হলে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একপ্রকার ‘ব্যর্থ প্রকল্প’ হিসেবেই চিহ্নিত হতে যাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার হাসপাতালটি। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে কিন্তু প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় জনবলই নিয়োগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় হাসপাতালটি স্থাপনে স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন বিএসএমএমইউর এক সাবেক উপাচার্য একে ‘ভূতুড়ে হাসপাদতাল হিসেবে অভিহিত করেন।
সাবেক এই উপাচার্য রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘অনেক স্বপ্ন নিয়ে এই প্রকল্পের কাজে হাত দিয়েছিলাম। প্রকল্পটি বাস্তবায়নও হলো, কিন্তু গুটি কয়েক মানুষের স্বার্থের কারণে পুরোপুরি ব্যর্থ প্রকল্পে রূপ নিয়েছে এটি। আমরা এমনটি চাইনি। কোনো বড় প্রকল্পই এক দিনে সফল হবে না, এ কথা ঠিক আছে। কিন্তু তিন বছর পার হয়ে গেলেও ন্যূনতম সেবাটুকুও পাওয়া যাবে না? যেখানে পাশেই দুইটা হাসপাতালে রোগীদের দীর্ঘ লাইন থাকে, সেখানে এত বড় একটা অবকাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হাসপাতালটিতে হাতে গোনা কয়েকজন রোগীও চিকিৎসা পাচ্ছে না। শুনেছি, সরকার থেকে এটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পরিকল্পনা চলছে। যদি তাও হয় ভালো। যেভাবেই হোক, সাধারণ মানুষ যেন চিকিৎসা পায়।’
জানা যায়, হাসপাতালটিতে সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত অধ্যাপকের কনসালটেশন ফি ৬০০ টাকা, সহযোগী অধ্যাপকের ৪০০ ও সহকারী অধ্যাপকের ৩০০ টাকা। আর বৈকালিক কনসালটেশনের জন্য অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকের ফি যথাক্রমে ১ হাজার, ৮০০ ও ৬০০ টাকা। শুধু তাই নয়, হাসপাতালটিতে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্ট দেখাতে চাইলেও চিকিৎসকদের সমপরিমাণ ফি-ই দিতে হয়। এ অর্থ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পাবে ১০০ টাকা।
কেন এই উচ্চ ফি জানতে চাইলে বিএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শাহীনুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই হাসপাতালের আয় দিয়েই কর্মী-স্টাফদের বেতন দিতে হয়। এটা তো আউটডোর না। ইনডোর চিকিৎসাসেবা। এখানে একটু আলাদা যতœ দিয়ে রোগী দেখা হবে, এটাই স্বাভাবিক। পার্শ্ববর্তী বিএমইউর তুলনায় এখানে আসা রোগীর সংখ্যা এত কম কেনÑ এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমাদের মোট ১ হাজার ৮০০ জনবল প্রয়োজন। নেওয়া হয়েছে ৫৫০ জনের মতো। আমরা এর উন্নয়নে কাজ করছি।
জানা যায়, ৭৫০ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটির অর্থায়ন করেছে কোরিয়ান কোম্পানি। বিশাল এই প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩৬৬ কোটি টাকা। তবে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে হাসপাতাল নির্মাণ, পরামর্শ ব্যয়, যন্ত্রপাতি ক্রয়সহ অন্যান্য বাবদ ১ হাজার ৪৭ কোটি টাকা ঋণ দেয় দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সহযোগিতা তহবিল এক্সিম ব্যাংক। কোরিয়া থেকে যন্ত্রপাতি আনতে কাস্টমস ডিউটি ও ইনকাম টেক্স বাবদ ৩৩৮ কোটি টাকা দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। হাসপাতাল নির্মাণের জায়গা দিয়েছে বিএমইউ। এর দাম ধরা হয় ১৭০ কোটি টাকা। সেন্টার বেইজড এই হাসপাতালের সব যন্ত্রপাতি সরবরাহ করছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কোম্পানি স্যামসাং।
হাসপাতালের উন্নয়নে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করছে না কেন জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আসলে এটা বিএমইউর অধীনে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি প্রতিষ্ঠান। বিএমইউ কাজ করছে। আমাদের কাছে কোনো প্রস্তাব নিয়ে এলে আমরা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করছি। কিন্তু কেন এটির উন্নয়ন হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা করা হবে।’