ঢাকা বুধবার, ০১ অক্টোবর, ২০২৫

লাল শাপলায় রঙিন গোপালগঞ্জের বিল

নিজস্ব প্রতিবেদক, গোপালগঞ্জ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১, ২০২৫, ১২:০৬ এএম

ভোরের আকাশে যখন হালকা লালচে আভা ছড়িয়ে পড়ে, তখন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া ও কোটালীপাড়ার বিস্তীর্ণ বিলগুলোতে শুরু হয় এক স্বপ্নিল আয়োজন। পানির বুকজুড়ে সারি সারি শাপলার কুঁড়ি তখনো ঘুমে আচ্ছন্ন। সূর্যের প্রথম রশ্মি যখন পানির গায়ে এসে পড়ে, ঠিক তখনই একে একে খুলতে শুরু করে লাল শাপলা। মুহূর্তেই যেন বিলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে লাল রঙের মেলা।

নৌকায় ভেসে ভোরের এই দৃশ্য দেখা মানেই অন্য এক জগতে হারিয়ে যাওয়া। চারপাশ নিস্তব্ধ, শুধু পাখির ডাক আর পানির মৃদু ঢেউয়ের শব্দ। সেই নীরবতার মাঝেই ধীরে ধীরে জেগে ওঠে লাখো লাল শাপলা। দূর থেকে মনে হয়, পুরো বিল লালিমায় ভেসে যাচ্ছে।

স্থানীয়রা বলেন, শাপলার আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে ভোরবেলায় আসতেই হবে। দুপুর নাগাদ অনেক শাপলা বন্ধ হয়ে যায়, হারিয়ে যায় সেই রঙিন সমারোহ। তাই মানুষ ভোরেই নৌকা নিয়ে বের হন, কেউ ফুল সংগ্রহ করতে, কেউ শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

ঢাকা থেকে আসা আসলাম শেখ নামের এক পর্যটক জানালেন, ‘আমি ভোর ৪টায় উঠে নৌকা নিয়ে বের হয়েছিলাম। সূর্যের আলো ফুটতেই যখন একসঙ্গে এত শাপলা ফুটতে শুরু করল, তখন মনে হলো যেন প্রকৃতি নতুন করে জন্ম নিচ্ছে আমার চোখের সামনে।’

লাল শাপলার ভোর শুধু চোখের আরাম নয়, মনেও প্রশান্তি আনে। শহরের কোলাহল থেকে দূরে প্রকৃতির এমন নিঃশব্দ অথচ মহিমান্বিত আয়োজন সত্যিই এক অনন্য অভিজ্ঞতা।

শাপলার ভোর মানে প্রকৃতির সৃজনশীলতার সবচেয়ে কোমল ছবি। যিনি একবার এই দৃশ্য দেখবেন, তিনি আর কোনো দিন ভুলতে পারবেন না।

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া আর কোটালীপাড়ার বিস্তীর্ণ বিলগুলো যেন এখন এক স্বপ্নরাজ্য। দূর থেকে তাকালেই মনে হয়, কে যেন পুরো বিলে লাল গালিচা বিছিয়ে দিয়েছে। আসলে এগুলো লাল শাপলাÑ প্রকৃতির এক অনন্য উপহার। বর্ষায় পানি নামার পর প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় এসব শাপলা। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে চারপাশ হয়ে ওঠে লালে লাল, চোখজুড়ানো সৌন্দর্যে ভরে ওঠে মন।

স্থানীয়দের মতে, এ অঞ্চলের অন্তত ২৫টির মতো বিল এখন লাল শাপলায় ভরা। সাধারণত এগুলো এক ফসলি জমি। কৃষকেরা বোরো মৌসুমে ধান তোলার পর বর্ষার পানি জমে যায় মাঠে। সেই পানিতেই প্রতি বছর শাপলা জন্মায়। আশ্চর্য হলেও সত্যি, এসব ফুল কারও বোনা নয়, প্রকৃতিই এদের জন্ম দেয়।

শহরের কোলাহল থেকে একটু শান্তির খোঁজে ছুটে আসে বহু মানুষ। লাল শাপলার বিলের কাছে পৌঁছালে যেন মুহূর্তেই বদলে যায় মনের আবহাওয়া। স্থানীয় যুবকেরা নৌকায় ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দেন, ফলে দর্শনার্থীরা আরও কাছে থেকে উপভোগ করতে পারে এ দৃশ্য। অনেকেই ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, কেউ আবার নিশ্চুপ হয়ে শুধু তাকিয়ে থাকে শাপলার দিকে।

ঢাকা, খুলনা, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন আসছে পর্যটকেরা। কেউ সপরিবারে, কেউ বন্ধুদের সঙ্গে। পর্যটকদের ভাষায়, ‘শহরের পার্ক বা কৃত্রিম সৌন্দর্য নয়, এখানে প্রকৃতির আসল রূপ আছে। না দেখলে বোঝা যায় না প্রকৃতি কত উদারভাবে তার রং ছড়িয়ে দিতে পারে।’

গোপালগঞ্জের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, লাল শাপলার বিলগুলো ঘিরে পর্যটনবান্ধব পরিবেশ গড়ে তোলার পরিকল্পনা চলছে। দর্শনার্থীদের জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তবে সৌন্দর্যের এই আয়োজন চিরকাল থাকে না। পানি কমতে শুরু করলে কৃষকেরা আবার নেমে পড়বেন ধান চাষে। তখন সোনালি ধানে ভরে উঠবে বিলগুলো। তাই এই লালিমা দেখতে হলে এখনই আসতে হবে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া আর কোটালীপাড়ার বিলে। যত দিন পানি থাকবে, তত দিন শাপলার লাল গালিচা বিছানো থাকবে। ততদিনই মানুষ ছুটে আসবে এই সৌন্দর্যের টানে।