জুলাই-আগস্টের আন্দোলন চলাকালে হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর তথ্য বিস্তারিতভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তুলে ধরেছেন প্রধান কৌঁসুলি (চিফ প্রসিকিউটর) মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনা তিন ব্যক্তির সঙ্গে কথোপকথনে নিশ্চিত করেছেন যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তিনি প্রাণঘাতী অস্ত্র (ল্যাথাল উইপন) ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের হত্যার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি (শেখ হাসিনা) ড্রোন ব্যবহার করে অবস্থান শনাক্ত করে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে হত্যারও নির্দেশ দিয়েছেন। হাসানুল হক ইনুকে তিনি নিশ্চিত করছেন যে, নারায়ণগঞ্জে হেলিকপ্টার থেকে ছত্রীসেনা নামানো হবে এবং ওপর থেকে ‘বম্বিং’ করা হবে, ‘প্যারাট্রুপার’ নামানো হবে।
গতকাল বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ চতুর্থ দিনের যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন তিনি। পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে এদিন দুটির যুক্তিতর্ক শেষ হয়েছে। আজ বৃহস্পতিবারও প্রসিকিউশন যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন প্রধান কৌঁসুলি। এর আগে মঙ্গলবার হাসিনার সঙ্গে হাসানুল হক ইনু, শেখ ফজলে নূর তাপস ও এস এম মাকসুদ কামালের কথোপকথনের অডিও আদালতে শোনানো হয়।
তাজুল ইসলাম বলেন, “এসব কথোপকথনের মধ্যদিয়ে হত্যাকা- সংঘটিত করার অর্থাৎ দেশব্যাপী ‘ওয়াইডস্প্রেড’ এবং ‘সিস্টেমেটিক’ যে হামলার কথা আমরা বলছি, সেটি সংঘটনের জন্য তার (শেখ হাসিনা) সরাসরি নির্দেশ প্রমাণিত হয়েছে।” শেখ হাসিনার সঙ্গে কথোপকথনের যে অডিও ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা হয়েছে, সেখানে তার কণ্ঠ সঠিক, নাকি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে করা হয়েছে সে বিষয়ে প্রসিকিউশনের তরফে বক্তব্য রাখার কথা বলেছেন প্রধান কৌঁসুলি।
চিফ প্রসিকিউটর বলেন, পরিষ্কারভাবে দেখিয়েছি, বাংলাদেশের সিআইডি-তারা ফরেনসিক পরীক্ষা করে বলেছে, এই কণ্ঠস্বর শেখ হাসিনার এবং তার সঙ্গে যাদের কথা হয়েছে শেখ ফজলে নূর তাপসের কণ্ঠস্বর তারা নিশ্চিত করেছেন। হাসানুল হক ইনুর কণ্ঠস্বর তারা নিশ্চিত করেছেন। মাকসুদ কামালের কণ্ঠ তারা নিশ্চিত করেছেন। এই কথোপথন যে এআই দিয়ে করা হয়নি, সেটি তারা নিশ্চিত করেছেন।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের বাইরের দুটি প্রতিষ্ঠান বিবিসি এবং আলজাজিরা। বিবিসি তাদের একটা আলাদা প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে এই কণ্ঠস্বর এআই দিয়ে করা হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছে। তারা নিশ্চিত করেছে এটা শেখ হাসিনার কণ্ঠ, এআই দিয়ে করা নয়।
হত্যার নির্দেশনার ব্যাপারে প্রধান কৌঁসুলি বলেন, নির্দেশটা যে সত্যিকার অর্থে শেখ হাসিনা দিয়েছিলেন পুলিশ বাহিনীর তদনীন্তন প্রধান সরাসরি আদালতে সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন যে, প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার করা, হেলিকপ্টার ব্যবহার করার নির্দেশনা তিনি পেয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে টেলিফোন করে জানান, প্রধানমন্ত্রী তাকে এ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি তখন এ নির্দেশটি তার অধস্তন কর্মকর্তাদের জানান। অধস্তন কর্মকর্তারা অর্থাৎ ডিএমপির তদানীন্তন কমিশনার হাবিব, প্রলয় জোয়ার্দারÑ তারা কমান্ড সেক্টরের মাধ্যমে, ওয়্যারলেস মেসেজের মাধ্যমে বিভিন্ন কমান্ড পোস্ট, বিভিন্ন জায়গায় যেসব বাহিনীকে নিয়োগ করা হয়েছে, তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়।
হেলিকপ্টার থেকে গুলি বিষয়ে তিনি বলেন, ‘হেলিকপ্টার থেকে যে গুলি করা হয়েছে এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বাহিনীগুলোর কাছ থেকে ‘ডিটেইলড ফ্লাইটের চার্টার’ আমরা সংগ্রহ করেছি। সে ফ্লাইটগুলোতে কতক্ষণ ফ্লাইটের ডিউরেশন ছিল সেগুলো আমরা দেখিয়েছি, সে ফ্লাইটগুলো অপারেট করেছেন কোন কোন পাইলট তাদের নাম ও ফোন নাম্বার আমরা দেখিয়েছি। ওইখানে পাইলট ছাড়া আর কোন কোন সৈনিক বা অফিসার যাত্রী ছিলেন তা আমরা দেখিয়েছি।’ এ ছাড়া সেখানে কী কী অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, তোলা হয়েছে তার তালিকা, কত রাউন্ড গুলি করা হয়েছে তার তালিকা দিয়েছেন বলে তাজুল তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, সেখানে এসএমজি, লাইট মেশিনগান, শটগান, রাইফেল, সাউন্ড গ্রেনেড, স্টান গ্রেনেড সবকিছুর হিসাব আছে। ভিডিও ফুটেজ, আহতদের গুলিবিদ্ধ হওয়া, শহিদ এবং আহতদের শরীর থেকে যে বুলেটগুলো বের করা হয়েছে তাও আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই যে চেইন, হুকুম দেওয়া থেকে শুরু করে মাঠপর্যায় পর্যন্ত কার্যকর হওয়া এবং সেটার পরিণামে কীভাবে মানুষগুলো মারা গেল তাদের দেহ থেকে কীভাবে বুলেট উদ্ধার হলো, এ বুলেটগুলো কোন গ্রেডের, কোন রাইফেল থেকে এসেছে, কাদের কাছ থেকে এসেছেÑ এসবকিছুর অকাট্য প্রমাণ ট্রাইব্যুনালে আমরা তুলে ধরেছি।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে এ মামলায় পাঁচটি অভিযোগ রয়েছে। গত ১০ জুলাই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। মামলার ৫৪তম ও শেষ সাক্ষী ছিলেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মো. আলমগীর। গত ৬ অক্টোবর আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন তার জেরা শেষ করেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন