ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে জোরেশোরে প্রস্তুতি শুরু করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে সাংবাদিক ও সুশীল সমাজের সঙ্গে সংলাপ করে সংস্থাটি। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার তিন বাহিনীর প্রধান, মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) ও অন্যান্য বাহিনীর প্রধানদের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের নেতৃত্বে ইসি কমিশনাররা। এ সময় আলোচনায় উঠে আসে নির্বাচনকালে কীভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ হবে। যেকোনো অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নির্বাচনের সময় সারা দেশে এক লাখ সেনা ও দেড় লাখ পুলিশ মোতায়েন থাকবে। এর বাইরেও সাড়ে ৫ থেকে ৬ লাখ আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করবে। শুধু তাই নয়, আলোচনায় ভোটের আগে-পরে অন্তত ৮ দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে রাখার প্রস্তাব করা হয় সংলাপে। এ সময় ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের ৮৫ শতাংশই উদ্ধার হয়েছে উল্লেখ করে জানানো হয় বাকিগুলোও নির্বাচনের আগেই উদ্ধার হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের শতভাগ পরিবেশ রয়েছে বলে দাবি করেছেন ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ।
ভোটের আগে-পরে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে যত পরিকল্পনা : এদিন নির্বাচন ভবনে আইনশৃঙ্খলাবিষয়ক প্রাক-প্রস্তুতিমূলক বৈঠক শেষে ইসির জ্যেষ্ঠ সচিব আখতার আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, এবার ভোটের মাঠে ৫ দিন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রাখার পরিকল্পনা ছিল ইসির। আজকের বৈঠকে ৮ দিন রাখার প্রস্তাব এসেছে। এটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। ভোটের আগে ৩ দিন, ভোটের দিন ও ভোটের পরের ৪ দিন নিরাপত্তায় থাকবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
নির্বাচন ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কোনো ধরনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়নি জানিয়ে ইসি সচিব বলেন, সংলাপে এআইয়ের অপব্যবহার রোধ, ড্রোন ব্যবহার নিষিদ্ধ ও পুলিশের ইউনিফর্মে ক্যামেরা থাকার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
আরও যত আলোচনা
বৈঠকে আর কী কী বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, ভোটকেন্দ্র, নির্বাচন কর্মকর্তা, নিরাপত্তা, নির্বাচনি এলাকাসহ নির্বাচনসংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কীভাবে হবে, বিদেশি সাংবাদিক-পর্যবেক্ষকদের নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বিগত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনেও ৮ দিনের জন্য মাঠে নেমেছিল সশস্ত্র বাহিনী। তবে যাতায়াতের জন্য আরও পাঁচ দিন সময় নিয়েছিল। এর আগে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ১০ দিন মাঠে ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষমতা
নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী সিভিল পাওয়ার নিয়ে উপস্থিত থাকবে কি নাÑ এমন প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব আখতার বলেন, এটা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তারা ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’ আছে। কিন্তু এটার সঙ্গে আরপিও সাংঘর্ষিক যেন না হয় সেটা আমরা খেয়াল রাখব।’ নির্বাচন নিয়ে কোনো ঝুঁকি আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দেখছে কি না এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটুকু ভোটের উপযোগী, জানতে চাইলে ইসি সচিব বলেন, ‘নির্বাচনের সময়সীমা হচ্ছে তপশিল ঘোষণা থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত। আমাদের আলোচনার পরিধিটা এটুকু ছিল। বাকিটুকু নিয়ে আলোচনার এই মুহূর্তে সুযোগ নেই এবং আমরা করিওনি। আমি তাদের মধ্যে উদ্বেগ দেখিনি। বরং দেখেছি যে, তারা একটা ভালো ইলেকশন করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ইসি সচিব আরও বলেন, কেউ আশঙ্কা প্রকাশ করেননি। আশঙ্কা প্রকাশের কোনো কারণ এখানে ছিল না। নির্বাচনের পরিবেশ আছে কি নাÑ জানতে চাইলে আখতার আহমেদ বলেন, অবশ্যই নির্বাচন করার মতো পরিবেশ আছে এবং সেটা আরও সংহত করতেই আজকের আলোচনা এবং এটা চলমান থাকবে।
এ সময় তিনি আরও জানান, জুলাই আন্দোলনের সময় লুট হওয়া অস্ত্রগুলো উদ্ধারের বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত ৮৫ শতাংশ তারা রিকভারি করেছেন। আরও কিছু অস্ত্র ও গোলাবারুদ এখনো পর্যন্ত আছে। উদ্ধার প্রক্রিয়া চলমান।
পুলিশের থাকবে ‘বডি ওর্ন’ ক্যামেরা
আখতার আহমেদ আরও বলেন, পুলিশের ‘বডি ওর্ন’ ক্যামেরা থাকবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ছাড়া কেউ ড্রোন ব্যবহার করতে পারবে না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ব্যবহার করবে। তারা বলেছে, যানবাহন একটা সমস্যা, রিকুইজিশন করতে হবে। ইসি সচিব বলেন, আজকে সূচনা হলো আলোচনার। এখানেই শেষ নয়। এটা ধারাবাহিকভাবে আরও এগোবে। আরেকটা বড় জিনিস আছে, যেটা বাজেট। প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠান, প্রত্যেকটা ইউনিটের একটা বাজেট তাদের খরচ আছে, সেটা আমাদের দেবে, আমরা ইলেকশন বাজেটের সঙ্গে যেটা সম্পর্কিত সেই বাজেট করব।
ঝুঁকির কিছু দেখছে না ইসি
নির্বাচন নিয়ে কোনো ঝুঁকি দেখছে কি না এবং আইনশৃঙ্খলার যে পরিস্থিতি আছে, সেটা কতটুকু ভোটের জন্য উপযোগীÑ এমন প্রশ্নের জবাবে আখতার আহমেদ বলেন, নির্বাচনের সময়সীমা তপশিল ঘোষণা থেকে গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত। আমাদের আলোচনার পরিধিটা এটুকু ছিল। বাকিটুকু নিয়ে আমাদের আলোচনার এই মুহূর্তে সুযোগ নেই। আমি তাদের ভেতরে উদ্বেগ দেখিনি। বরং দেখেছি যে, একটা ভালো ইলেকশন করার মতো পরিবেশ আছে, তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অবশ্যই নির্বাচন করার মতো পরিবেশ আছে এবং সেটা আরও সংহত করার জন্যই আজকের আলোচনা এবং এটা চলমান থাকবে। তিনি আরও বলেন, মূলত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাঁচ দিনের জন্য ‘ডেপ্লয়মেন্ট প্রোগ্রাম’ করা হয়। সেখানে একটা প্রস্তাব এসেছে, এটা যেন আট দিন করা হয়। নির্বাচনের আগে তিন দিন, নির্বাচনের দিন এবং নির্বাচন পরবর্তীতে চার দিন। আমাদের ‘ইনিশিয়াল প্রোগ্রামিং’ ছিল পাঁচ দিনে। এখন প্রস্তাবনাটা আসছে আট দিন। এটা আমরা পরীক্ষা করে দেখব।
এআইর অপব্যবহার রোধে তৎপরতা
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) অপব্যবহার নিয়ে ইসি সচিব বলেন, এআইর অপব্যবহারের ক্ষেত্রে এনটিএমসি যে ব্যবস্থাটা নিয়েছিল পূজার সময়; ৩৫ হাজারের বেশি পূজাম-পে ওনারা তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারটা করেছেন। সেটা একটা সফল ইভেন্ট ছিল। সেটা আমরা ব্যবহার করতে পারি কি না, সে আলোচনা হয়েছে। মঙ্গলবার (আজ) এ ব্যাপারে একটা সেমিনার আছে। সেটাতে আমরা আরও কিছু তথ্য সমাবেশ করে এই জিনিসটা দেখব।
প্রস্তুত থাকবে হ্যালিপ্যাড
ভোটে হেলিকপ্টার ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, আর্মি এভিয়েশন, এয়ারফোর্স এভিয়েশন চপারে করে নির্বাচন সামগ্রী পরিবহনের ব্যবস্থা করবে। এক্ষেত্রে সব হ্যালিপ্যাড প্রস্তুত রাখার আলোচনা হয়েছে। আখতার আহমেদ আরও বলেন, আমরা ‘এম্ফাসাইজ’ করেছি যে, ‘ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিং’। প্রত্যেকটা অর্গানাইজেশনে তাদের কিছু নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স তারা কালেক্ট করে। কিন্তু ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিংটা হবে, করলে জিনিসটা আরও সুসংহত হবে। কেননা কোনো একটা অর্গানাইজেশন হয়তো এক জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ মনে করেছেন, আরেকজন করেছেন তিনটা জায়গা, এটা সমন্বয় করলে ভালো হবে। এই কো-অর্ডিনেশনের ভিন্ন লেভেলগুলো যেন স্বচ্ছ থাকে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সেটার সঙ্গে কমান্ড স্ট্রাকচারটা যে কে দায়িত্ব নিয়ে কথাটা বলবেন, একেক জায়গায় একেক রকমের পরিস্থিতি হতে পারে, যেমন কোস্টাল এরিয়াতে যে কমান্ড স্ট্রাকচারটা হবে, সেটা বর্ডার এরিয়াতে হবে না। এ রকম জায়গাগুলো নিয়ে আরেকটু ফার্নিশ করতে হবে।
যাদের উপস্থিতিতে সংলাপ
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে চার নির্বাচন কমিশনার, ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি, পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম, সেনাবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি লেফট্যানেন্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম, বিমানবাহিনীর প্রধানের প্রতিনিধি এয়ার ভাইস মার্শাল রুশাদ দিন আসাদ, নৌবাহিনী প্রধানের প্রতিনিধি রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসএম কামরুল হাসান, এনএসআইর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবু মোহাম্মদ সরোয়ার ফরিদ, ডিজিএফআইর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল জাহাঙ্গীর আলম, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, আনসার ভিডিপি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আব্দুল মোতালেব সাজ্জাদ মাহমুদ, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. জিয়াউল হক, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবদুল কাইয়ুম মোল্লা, র্যাবের মহাপরিচালক একেএ মশহিদুর রহমান, এসবির অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক (প্রশাসন ও অর্থ) জিএম আজিজুর রহমান এবং সিআইডির অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মো. ছিবগাত উল্ল্যাহও বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ভোটের লক্ষ্যে সব প্রস্তুতি গুছিয়ে নিচ্ছে ইসি। এক্ষেত্রে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তপশিল ঘোষণা করা হতে পারে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন