মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৫, ১২:৩২ এএম

জবি শিক্ষার্থী হত্যা

ছাত্রীর প্রেমের বলি হলেন ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: অক্টোবর ২১, ২০২৫, ১২:৩২ এএম

ছাত্রীর প্রেমের বলি হলেন  ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ

  • ছাত্রী বর্ষা ও তার ও প্রেমিক মাহির পুলিশ হেফাজতে
  • বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের কার্যক্রম স্থগিত
  • দুই দিনের শোক পালনের সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের
  • শেষবারের মতো কফিনবন্দি হয়ে ঘুরে গেলেন ক্যাম্পাস
  • অপরাধী কাউকে ছাড় নয়: ডিসি লালবাগ

মা-বাবার স্বপ্ন পূরণ আর এক বুক আশা নিয়ে যে ছেলেটা ভর্তি হয়েছিল দেশের উচ্চশিক্ষার বিদ্যাপীঠ জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ে (জবি), মুখরিত ক্যাম্পাসে ছিল যার অবাধ পদচারণ। প্রাণচঞ্চল সেই ছেলেটা শেষবারের মতো কফিনবন্দি হয়ে ঘুরে গেলেন তার প্রিয় ক্যাম্পাস। কফিনবন্দি হয়ে পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী জোবায়েদ হোসাইন যখন ক্যাম্পাসে এলেন, তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে তখন হাজারো শিক্ষার্থী। ছিলেন শিক্ষক, পরিবারের সদস্যরাও। জুবায়েদকে শেষ বিদায় জানানো হয় সেখানেই। নিহতের ময়নাতদন্ত শেষে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে নেওয়া হয় গতকাল সোমবার দুপুরে। বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য তৈরি করা প্যান্ডেলেই বাদ জোহর জানাজা শেষে দাফনের জন্য জোবায়েদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়। এ সময় ছেলের প্রিয় ক্যাম্পাসে দাঁড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন বাবা মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, ‘৫৮ বছরের জীবনের সব অর্জন শেষ, এখন লাশ নিয়ে যাচ্ছি।’

এদিকে আলোচিত এ হত্যাকা-ে উঠে এসেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্ত ছাত্রী বার্জিস শাবনাম বর্ষা জানিয়েছেন, সে ও তার প্রেমিক মাহির রহমানের প্রেমঘটিত জটিলতার জেরে খুন হন জবি শিক্ষার্থী ও ছাত্রদল নেতা জোবায়েদ হোসাইন। তবে জোবায়েদের এই খুনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন সম্পর্কে কোনো কিছু বর্ষা জানতেন না বলে পুলিশকে জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে মাহিরকে পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। বর্ষাকেও পুলিশ হেফাজতে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।

জোবায়েদ খুনের ঘটনায় আগামী ২২ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে জোবায়েদের স্মরণে দুই দিনের শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

গতকাল বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রী বর্ষার সাথে মাহির রহমানের ৯ বছরের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। মাহির রহমান বুরহান উদ্দীন কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র। আর বর্ষা পড়ত ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজে দ্বিতীয় বর্ষে। পাশাপাশি বাড়িতে তাদের বেড়ে ওঠা। তাদের মধ্যে ছিল দীর্ঘ প্রেমের সম্পর্ক। চতুর্থ শ্রেণি থেকে একে অপরকে পছন্দ করত। কিন্তু সম্প্রতি তাদের সম্পর্কে টানাপোড়েন ঘটে। কিছুদিন আগে তাদের সম্পর্কের ভাঙন হয়। বর্ষা তার বয়ফ্রেন্ড মাহির রহমানকে জানায়, সে জোবায়েদকে পছন্দ করে। এটা জানার পর রাগে-ক্ষোভে জোবাইদকে মাহির রহমান ও তার বন্ধুকে নিয়ে হত্যা করেছে।

ওসি বলেন, সম্প্রতি বর্ষা মাহিরকে জানায় যে, সে জোবায়েদকে পছন্দ করে। কিন্তু জোবায়েদকে সে তার পছন্দের কথা এখনো জানায়নি। জোবায়েদের সাথে বর্ষার কোনো প্রেমের সম্পর্ক নেই। তাদের মধ্যে এ ধরনের কোনো মেসেজও পাওয়া যায়নি। কিন্তু বর্ষার কথার ওপর ভিত্তি করে রাগে-ক্ষোভে বর্ষার প্রেমিক মাহির তার এক বন্ধুকে সাথে করে জোবায়েদকে খুন করে।

বর্ষা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে বলেছে, বর্ষার সাথে জোবায়েদের বন্ধু সৈকতের পরিচয় হয় ফেসবুকে। এ ছাড়া অন্য কোনো মাধ্যমে তাদের কথা হতো না বা অন্য কোনো সম্পর্কও ছিল না। যেহেতু সৈকত জোবায়েদের বন্ধু ছিল, এ জন্য জোবায়েদের মৃত্যুর খবর দিয়ে সৈকতকে মেসেজ করে বর্ষা।

ওসি বলেন, বর্ষার মধ্যে কোনো হতাশা বা কান্নার ছাপ পাওয়া যায়নি। জিজ্ঞাসাবাদেও তার মধ্যে কোনো নার্ভাসনেস পাওয়া যায়নি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বর্ষাকে চিন্তামুক্ত দেখা গেছে। আমরা আরও বিস্তর তদন্ত করব। পরে আরও বিস্তারিত জানানো হবে আনুষ্ঠানিকভাবে। 

অভিযুক্ত মাহিরকে থানায় দিলেন মা:

জবি শিক্ষার্থী জোবায়েদ হত্যার ঘটনায় মাহিরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গত রোববার রাতে পুলিশ কয়েক স্থানে অভিযানের পর গতকাল ভোরে মাহিরের মা নিজেই ছেলেকে নিয়ে বংশাল থানায় হাজির হন এবং তাকে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন।

জোবায়েদ জবির বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। একই সাথে তিনি কুমিল্লা জেলা ছাত্র কল্যাণের সভাপতি ও জবি শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সদস্য ছিলেন। গত এক বছর ধরে জোবায়েদ পুরান ঢাকার আরমানীটোলায় ১৫, নুরবক্স লেনে রৌশান ভিলা নামের বাসায় বর্ষা নামের ওই ছাত্রীকে ফিজিকস, ক্যামেস্ট্রি ও বায়োলজি পড়াতেন। গত রোববার ওই বাসায় যাওয়ার পথেই খুন হন জোবায়েদ।

পরবর্তী সময়ে আসামিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে বংশাল থানার সামনে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পাশাপাশি তারা তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ করেন। রোববার রাত ১১টার দিকে বর্ষাকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত এ খুনের ঘটনায় কোনো মামলা হয়নি। নিহত জুবায়েদের বড় ভাই এনায়েত হোসেন সৈকত থানায় একটা লিখিত অভিযোগ দিলেও সেটা রেকর্ড হয়নি।

সৈকত বলেন, আমারা ওই ছাত্রী, তার বাবা-মাসহ ৫ জনের নামে মামলা দিতে চাইলে বংশাল থানার ওসি এতজনের নামে মামলা না দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি জানান, ওই মেয়ের বাবা-মায়ের নামে মামলা দিলে নাকি মামলা হালকা হয়ে যাবে। কিন্তু আমরা মামলায় তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই। আমার ভাই হত্যার বিচার চাই।

মামলায় বিলম্বের বিষয়ে বংশাল থানার ওসি রফিকুল ইসলাম বলেন,  যে কয়েকজনের নামে মামলা দিতে চায় নেব, তবে তাদের বলেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে।

এদিকে জোবায়েদ হত্যাকা-ের বিচারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কঠোর অবস্থান নিয়েছে। ইতিমধ্যে আগামীকাল বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সব কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। একই সঙ্গে জোবায়েদের স্মরণে দুই দিনের শোক পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

গতকাল সকাল ১১টায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক, ছাত্রনেতা ও সাংবাদিকদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সভায় সিদ্ধান্ত হয়, ২১ ও ২২ অক্টোবর দুই দিন শোক পালন করা হবে। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পরীক্ষা স্থগিত থাকবে, তবে ক্লাস চলবে। শোকের দুই দিনের প্রথম দিন শোক সভা এবং  দ্বিতীয় দিন বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শোকর‌্যালি করা হবে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের সব আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা স্থগিত থাকবে।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মো. রইছ উদ্দিন বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা আমাদের সন্তান। জোবায়েদকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমরা ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে বসব, প্রশাসনের পক্ষ থেকেও উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমাদের একটাই দাবি, হত্যাকা-ের বিচার। বিচার না হলে শিক্ষার্থীদের নিয়ে পুরান ঢাকা অচল করে দেব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, ‘জোবায়েদের মৃত্যু আমাদের গভীরভাবে শোকাহত করেছে। তাই এবারের বিশ্ববিদ্যালয় দিবস উদযাপন স্থগিত করা হলো। সাজসজ্জা থাকলেও লাইট জ্বলবে না। জোবায়েদ হত্যার সুষ্ঠু বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।’

‎গতকাল সোমবার দুপুর ১টার দিকে জুবায়েদের লাশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আনা হয়। এ সময় জুবায়েদের সহপাঠী, শিক্ষক ও নেতাকর্মীরা শেষবারের মতো তার মরদেহ দেখেন। এরপর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ভবনের মাঠে জুবায়েদের জানাজা হয়। জানাজার পর তার লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। 

জানাজায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী উপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়া, শাখা ছাত্রশিবির, বাগছাস, ছাত্র অধিকার, আপ বাংলাদেশসহ অন্যান্য ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনের নেতারা অংশগ্রহণ করেন।

এ সময় জুবায়েদের বাবা মো. মোবারক হোসেন বলেন, এখন আমার একটাই চাওয়াÑ ন্যায়বিচার। আমি ন্যায়বিচার চাই। একটু আগে আমার সঙ্গে এ এলাকার ডিসির সঙ্গে কথা হয়েছে। তিনি আমাকে আশ্বস্ত করেছেন। ধৈর্য ধরতে বলেছেন। প্রকৃত খুনিকে দ্রুত গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, আমি আমার ছেলেকে দিয়েছিলাম ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করে অনেক বড় হবে। কিন্তু আজকে আমার ছেলে লাশ। আমি বাবা এখনো বেঁচে আছি। সবার কাছে আমার ছেলের জন্য দোয়া চাই।

কথাগুলো বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন মোবারক হোসেন। নিজেকে সামলে নিয়ে আরও বলেন, ‘আমার ৫৮ বছরের জীবনের সব অর্জন শেষ। আমার প্রাণের জোবায়েদ আর নেই। আমার কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমি হত্যাকা-ের সুষ্ঠু বিচার চাই। সরকারের কাছে শুধু এই দাবি জানাই।’

এ সময় উপস্থিত ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক নাসিরুদ্দিন নাসির বলেন, আমরা সমবেদনা জানাচ্ছি। এই মাসের ৩ তারিখ আরেক জবি শিক্ষার্থী মৃত্যুবরণ করেন। গণঅভ্যুত্থান ৫ আগস্টের পরে ৪ জন ছাত্রদল নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকা-।  দেশের বিচারব্যবস্থা ও আইন কর্মকর্তাদের ওপর ভরসা রাখতে হবে। প্রকৃত আসামিদের বিচার হওয়া উচিত। খুব দ্রুত সময়ে প্রকৃত দোষীদের শনাক্ত করে, আমরা বিশ্বাস করি দ্রুত সময়ে ঘাতকদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়েদ হোসাইনের জানাজা শেষে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশের লালবাগ বিভাগের ডিসি মল্লিক আহসান উদ্দিন সামি বলেন, সঠিক তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে, তবে তদন্তের স্বার্থে সব কিছু এখনই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমরা ইতিমধ্যে বেশ কিছু তথ্য পেয়েছি। আশা করছি, আগামীকাল সকাল ১০টার মধ্যে আপনাদের সুসংবাদ দিতে পারব। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন নাসির বলেন, জুবায়দের বড় ভাই সৈকত ৪৯তম বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন; কিন্তু জুবায়েদ সে খুশির খবর জেনে যেতে পারল না।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!