‘এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া বাড়ানোসহ তিন দফা দাবি আদায়ে গত ১২ অক্টোবর ঢাকায় এসেছি। এর পর থেকে রাস্তাঘাটে থাকছি। ঠিকমতো খাওয়া নেই, ঘুম নেই। তারপরও আমরা পিছু হটছি না। হয় আমাদের দাবি পূরণ হবে, না হয় এই রাস্তায় আমরা আমাদের জীবন দিয়ে দেব। তবুও দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা এবার রাজপথ ছেড়ে যাব না।’
গতকাল দুপুরে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে রূপালী বাংলাদেশের কাছে এসব কথা বলেন সিরাজগঞ্জের মটিয়ারপুর ইসলামি সিনিয়র মাদরাসার শিক্ষক সাইদুল ইসলাম জীবন। শুধু সাইদুল নয়, তার মতো একই বক্তব্য শহিদ মিনারে অবস্থান নেওয়া সহস্রাধিক শিক্ষকের।
কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি থেকে স্কুল শিক্ষক খাদেমুল ইসলাম স্ত্রী আর তিন সন্তান নিয়ে এসেছেন শহিদ মিনারে। কাফনের কাপড় গায়ে দিয়ে দাবি আদায়ে দিচ্ছিলেন নানা স্লোগান। খাদেমুল ইসলাম বলেন, ‘২৫ বছর ধরে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের দাবিতে আমি রাজধানীসহ জেলা-উপজেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে আন্দোলন করেছি। এবার শহিদ মিনারে এসেছি। হয় জাতীয়করণ না হয় মৃত্যুবরণ। কাফনের কাপড় যখন গায়ে জড়িয়েছি, ২০ শতাংশের দাবি যতক্ষণ পূরণ হবে না, ততক্ষণ ঘরে ফিরে যাব না। প্রয়োজনে এখান থেকে আমার লাশ বাড়ি যাবে।’
এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা তাদের মূল বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া ভাতা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৫০০ টাকা এবং উৎসব ভাতা মূল বেতনের ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭৫ শতাংশ করার দাবিতে ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটে’র ব্যানারে গত ১২ অক্টোবর রোববার থেকে আন্দোলন করছেন। ওই দিন সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি শুরু হলেও দুপুরে পুলিশের অনুরোধে তারা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে চলে যান। ওই দিন দুপুরে শিক্ষকদের একটি অংশের ওপর পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে, জলকামানের পানি ছিটিয়ে এবং লাঠিপেটা করে সরিয়ে দেয়। শিক্ষকদের ওপর ‘পুলিশের হামলার’ প্রতিবাদে পরদিন সোমবার থেকে সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে লাগাতার কর্মবিরতি ঘোষণা করা হয়। এর পর থেকে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই বন্ধ রয়েছে পাঠদান।
দাবি আদায়ে ১২ অক্টোবর থেকেই শহিদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। ইতিমধ্যে বাসাভাড়া ৫ শতাংশ বাড়িয়ে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপন জারি করলেও তা প্রত্যাখ্যান করেছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন, তাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত শহিদ মিনার ছাড়বেন না। গত রোববার মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) অভিমুখে ভুখা মিছিল করেছেন তারা। গতকাল সোমবার শহিদ মিনারে গিয়ে দেখা যায়, শহিদ মিনারের চারদিকেই শুধু শিক্ষক আর শিক্ষক। কেউ কেউ শহিদ মিনার ঘুরে বিভিন্ন স্লোগান দিয়ে মিছিল করছেন। কেউ কেউ পত্রিকা কিংবা কাপড়ের ওপর শুয়ে-বসে রয়েছেন। শহিদ মিনারের মূল বেদিতে অনশনে বসেছেন দুই শতাধিক শিক্ষক-শিক্ষিকা। ইতিমধ্যে গতকাল পর্যন্ত শতাধিক শিক্ষক অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। এর মধ্যে অন্তত ৫০ জন শিক্ষক অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
বরিশালের আগৈলঝাড়া থেকে আসা অনশনরত শিক্ষক আজিজুল হক বলেন, ‘অনশনে যদি আমার মৃত্যু হয়, তবুও অনশন ভাঙব না। অনেক শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেছি; কিন্তু সরকার কর্ণপাত করেনি। এবার শেষ আন্দোলন। দাবি আদায় করেই ঘরে ফিরব।’
পঞ্চগড় থেকে আসা স্কুল শিক্ষিকা সুলতানা মাহফুজ নাহার বলেন, ‘আমার চিকিৎসাভাতা পাই মাত্র ৫০০ টাকা। অথচ এখন একজন ভালো ডাক্তার দেখাতে হলে এক হাজার টাকার বেশি ভিজিট দিতে হয়। শিক্ষা উপদেষ্টাকে বলতে চাই, যখন রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা অপচয় হয়, কোটি কোটি টাকা দিয়ে শিক্ষা কর্মকর্তারা বিদেশ গিয়ে অহেতুক প্রশিক্ষণ নেন, তখন টাকা আসে কোথা থেকে। তারপরও রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে আমরা ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া বাড়ানোর দাবি করেছি। এত ছাড় দেওয়ার পরও আমাদের ন্যায্য দাবি পূরণ করা হচ্ছে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘গত তিন-চার দিন থেকে শিক্ষকরা শহিদ মিনারে অনশন করছেন। অথচ একজন উপদেষ্টা আমাদের সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করতে আসলেন না। আমরা কি মানুষ না? আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আমরণ অনশন চালিয়ে যাব। এখান থেকে একচুলও নড়ব না।’
যশোর থেকে আসা শিক্ষিকা আফরোজা নাহার বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা হাহাকার করছেন, ম্যাডামরা কবে ক্লাসে আসবেন। তারা অনেকে আমাদের ফোন করছেন। আমরা দ্রুত ক্লাসে ফিরে যেতে চাই। কিন্তু সরকার কোটি কোটি শিক্ষার্থীর কথা একবারও ভাবছে না। মনে রাখা উচিত, দেশের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীই কিন্তু বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। আমাদের পেছনে রেখে দেশের শিক্ষাঙ্গন দাঁড়াতে পারবে না।’
গতকালের কর্মসূচি: গতকাল শহিদ মিনারে ২০০ শিক্ষক অনশনে বসেন। এদের মধ্যে বিকেল পর্যন্ত ৪ জন অসুস্থ হয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসা নিয়েছেন।
এ ছাড়া বেলা সাড়ে ১১টায় শহিদ মিনারে এসে বিক্ষোভ সমাবেশে যোগ দেন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি। সমাবেশে তিনি বলেন, ‘বর্তমান সরকার ঘোষিত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বাড়িভাড়া ভাতা মূল বেতনের ৫ শতাংশ যথেষ্ট নয়। তাই সরকারকে বিশেষ বিবেচনার অনুরোধ জানাই।’
এ ছাড়া দাবি-দাওয়ার সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে বক্তব্য দেন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খানসহ একটি প্রতিনিধিদল।
আজকের কর্মসূচি: দাবি আদায়ের জন্য আজ মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় মুখে কালো কাপড় বেঁধে শহিদ মিনার থেকে শাহবাগ পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন শিক্ষকরা। সন্ধ্যায় শহিদ মিনারে সংবাদ সম্মেলনে এমপিওভুক্ত ও শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজীজি বলেন, ‘আমরা ২২ অক্টোবর পর্যন্ত অপেক্ষা করব। ততক্ষণে যদি প্রজ্ঞাপন জারি করে আমাদের দাবি মেনে নেওয়া না হয়, তাহলে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তা বাংলাদেশ কখনো দেখেনি। সারা দেশের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের একযোগে ঢাকায় আনব এবং যমুনা ঘেরাও করা হবে।’
অধ্যক্ষ আজীজি আরও বলেন, ‘আজ থেকে আমাদের কর্মসূচি আমরণ অনশনে উন্নীত করা হয়েছে। ইতিমধ্যে চারজন অসুস্থ হয়ে পড়েছেন এবং হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন; এখানে (কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে অবস্থানরত) অনেকেই অসুস্থ। যদি আমরণ অনশনের কারণে কোনো প্রাণহানি ঘটে, তার দায়-দায়িত্ব শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরারের ওপর বর্তাবে।’ তিনি শিক্ষা উপদেষ্টার উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা তার সিদ্ধান্ত মানি না; তিনি যদি আমাদের দাবি মানতে না পারেন, তবে তাঁকে মন্ত্রণালয় ছাড়তেই হবে।’
কর্মসূচি সম্পর্কে তিনি জানান, যারা কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে উপস্থিত হতে পারবেন না, তারা প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত জেলা ও উপজেলার কেন্দ্রগুলোতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করবেন। বিভিন্ন স্থানে যেসব প্রশিক্ষণ চলছে, তা বাতিল করে আন্দোলনে যোগ দিতে শিক্ষকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন