ঢাকা রবিবার, ০৯ নভেম্বর, ২০২৫

নাগরিক সংলাপে বক্তারা

বৈষম্যবিরোধী আইন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৫, ১০:৪৮ পিএম

বৈষম্যবিরোধী আইন ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন নাগরিক সংলাপে অংশ নেওয়া বক্তারা। গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে ‘একটি কার্যকর বৈষম্যবিরোধী আইন প্রবর্তন’ শীর্ষক এই নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়। নাগরিক প্ল্যাটফর্ম এসডিজিস, বাংলাদেশ, বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) ও সিটিজেনস ইনিশিয়েটিভ আয়োজিত এই সংলাপটি ইউএনডিপি এবং সুইস দূতাবাসের সহায়তায় অনুষ্ঠিত হয়।

সংলাপে অংশ নিয়ে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক ও সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশে বৈষম্য মোকাবিলায় একটি আইনি কাঠামো প্রয়োজন।  বিগত সরকার বৈষম্যবিরোধী আইন করার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও সাহস দেখাতে পারেনি, এটি আমাদের বড় আক্ষেপের জায়গা। এ সময় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে একটি কার্যকর বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের ওপর জোর দেন তিনি।

দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘বিগত কয়েক বছর ধরে আমাদের মনে হয়েছে, বাংলাদেশে বৈষম্য মোকাবিলায় একটি আইনি কাঠামোর প্রয়োজন। আগের সরকারের সময়েও আমরা সর্বজনীন বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছিলাম, খসড়াও তৈরি হয়েছিল। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষাপটে, বিশেষ করে গত বছরের আগস্টে ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে বৈষম্যবিরোধী চেতনা উন্মোচিত হয়েছে, সেটি আমাদের উৎসাহিত করেছে। এটি শুধু কোটা আন্দোলন নয়; বরং বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। এখনই সময় সেই চেতনাকে আইনি কাঠামোয় রূপ দেওয়া।’

ড. দেবপ্রিয় তিনটি বিষয়ের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করেন। সেগুলো হলো বিচার, নির্বাচন ও সংস্কার। তার ভাষায়, ন্যায্য বিচার চাইলে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে হবে, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। তেমনি সুষ্ঠু নির্বাচন ও কার্যকর সংস্কারের ক্ষেত্রেও একটি সর্বজনীন বৈষম্যবিরোধী আইনের প্রবর্তন অপরিহার্য।

তিনি আরও বলেন, ‘যদি ন্যায্য বিচার চান তাহলে নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে হবে। তার মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে হবে। বিচার পাব, ন্যায্য বিচার চাইব; কিন্তু নাগরিকের সুরক্ষা থাকবে না, এটা হতে পারে না। একই রকমভাবে যদি আমরা চাই নির্বাচন, তাহলে অবশ্যই এই সর্বজনীন বৈষম্যবিরোধী আইনের প্রয়োজন প্রবর্তন। এই আইনের প্রবর্তন নির্বাচনের ক্ষেত্রে একটি বার্তাবরণ পরিবেশ সৃষ্টি করবে। একই রকমভাবে যারা বলেন কার্যকর সংস্কার, কার্যকর সংস্কারে প্রথিত আছে নাগরিকের অধিকার, সর্বজনীন অধিকার। এটি না থাকলে আমরা মনে করি না সংস্কার কার্যকর হবে’, যোগ করেন তিনি।

তার মতে, সব ধরনের বৈষম্য নিয়ে কথা বলতে হবে। এ বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, ‘আমরা বৈষম্যবিরোধী কথা বলব, কিন্তু কোনো কোনো বৈষম্য নিয়ে কথা বলব আর কোনো কোনো বৈষম্য নিয়ে কথা বলব না এটা তো হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘নারী তার পছন্দ অনুযায়ী চলন-বলন এবং তার যে জীবনযাপনের অধিকার তার ওপরে যদি আমি খবরদারি করি, তাহলে তো আমার সর্বজনীন অধিকার হলো না। যে ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বা তার আত্মপরিচয়ের চেষ্টার ভেতরে আছে তাকে যদি আমরা জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি না দিই, ক্ষুদ্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আছে, তারা যদি জীবনযাপনের ক্ষেত্রে অসহায়ত্ব বোধ করে, তাহলে আমার বৈষম্যবিরোধী চেতনা হলো না।’

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি অ্যাটর্নি জেনারেল (এজি) মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলো যদি এই আইনটি প্রণয়নে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ না হয়, তবে তারা আমাদের ভোট পাবে না। আমাদের একটি শক্তিশালী আইন প্রয়োজন, কারণ একটি অস্পষ্ট আইন কোনো প্রতিকার দিতে পারে না। আমাদের এই বিষয়ে আইন কমিশন এবং আইন মন্ত্রণালয়কে বাধ্য করতে হবে।’

বাংলাদেশের সংবিধানকে বিশ্বের অন্যতম সেরা সংবিধান হিসেবে আখ্যা দিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘তাঁর বিশ্বাসের মূল নিহিত রয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সংবিধানের ওপর।’

অ্যাটর্নি জেনারেলের মতো, ব্যারিস্টার সারা হোসেনও বৈষম্যবিরোধী আইন প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে অঙ্গীকার চান। তিনি বলেন, ‘আমরা দাবি করছি যে এটি রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনি ইশতেহারে যুক্ত করা হোক। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছ থেকেও তাদের অবশিষ্ট সময়ের মধ্যে এ ব্যাপারে একটি উদ্যোগ দেখতে চাই।’

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং অ্যাটর্নি জেনারেলকে আইনটি প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘বৈষম্য অব্যাহত থাকলে আমরা একটি সভ্য রাষ্ট্র গঠন করতে পারব না।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে তার দলের সূচনার ভিত্তি হিসেবে অভিহিত করে, ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক খালিদ সাইফুল্লাহ বলেন, তারা কর্মসূচিতে উত্থাপিত বেশির ভাগ প্রস্তাবকেই সমর্থন করেন। তবে তিনি এই আইনের সুবিধাগুলো সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করার জন্য সব নাগরিকের জন্য পৃথক তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ এবং পরিচয় নিশ্চিত করার গুরুত্বের ওপর জোর দেন। সামাজিক বৈষম্য মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করে অর্থনীতিবিদ ড. এস আর ওসমানী বলেন, যদি এটি করা না হয়, তাহলে গণতন্ত্রের ধ্বংসস্তূপ থেকে একনায়কতন্ত্রের দানবের উত্থানের ঝুঁকি থেকেই যাবে। হিজড়া, চা শ্রমিক এবং হরিজনের মতো বিভিন্ন প্রান্তিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, এই বিষয়ে তাদের উদ্বেগ এবং পরামর্শ উত্থাপন করেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ব্লাস্টের নির্বাহী পরিচালক এবং সিনিয়র আইনবিদ ব্যারিস্টার সারা হোসেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন, এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক খালিদ সাইফুল্লাহ, গণফোরামের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সুব্রত চৌধুরী, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল কাফি রতন, অর্থনীতিবিদ ডক্টর এস আর ওসমানী, ইউএনডিপি বাংলাদেশের সিনিয়র উপদেষ্টা ড্রাগান পপোভিচ এবং মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম সংলাপে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন।