ঢাকা রবিবার, ০৯ নভেম্বর, ২০২৫

অতিরিক্ত উৎপাদনে কমেছে আলুর দাম

চৈতন্য চ্যাটার্জী, আক্কেলপুর (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি
প্রকাশিত: নভেম্বর ৮, ২০২৫, ১০:৪৯ পিএম

আক্কেলপুর কলেজ বাজার বণিক সমিতির সভাপতি ও বিশিষ্ট আলু ব্যবসায়ী মো. কাজী শফিউদ্দীন প্রতিবছরের মতো এবারও ৯ হাজার ৭শ বস্তা আলু কিনে রেখেছিলেন বগুড়া ঠেংগামারা কোল স্টোর ও নাটর বিশ্বাস কোল স্টোরে। ভালো দামে বিক্রির আশায় তিনি এই বিশাল পরিমাণ আলু মজুত করেছিলেন। তবে বাজারে আলুর দাম অস্বাভাবিক কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনি। দাম উৎপাদন খরচের নিচে নেমে যাওয়ায় এখন বড় অঙ্কের লোকসান গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ী শফিউদ্দীনকে। পাশাপাশি বাজারে ক্রেতার সংকট থাকায় হিমাগারে সংরক্ষিত আলু বিক্রি করতেও হিমশিম খাচ্ছেন তিনি।

ব্যবসায়ী কাজী শফিউদ্দীন বলেন, ‘প্রতিবছর এ সময় আলুর ভালো দাম পাওয়া গেলেও এবার অতিরিক্ত উৎপাদন ও বাজার অস্থিরতায় দাম পড়ে গেছে। ৩ হাজার ৭০০ বস্তা বিক্রি করেছি, পড়ে আছে ৭ হাজার। এতে প্রায় এক কোটি টাকার লোকসান হতে পারে। সরকার প্রণোদনা না দিলে ব্যবসায়ীরা হিমাগারে আলু রাখা ও কৃষকরা চাষে আগ্রহ হারাবে।’

একই অবস্থা মৌসুমী ব্যবসায়ী হারুনুর রশিদেরও। শুরুতে আলু কেনা থেকে হিমাগারে সংরক্ষণ পর্যন্ত প্রতি কেজিতে ২৩ টাকা খরচ হয়েছিল তার। বর্তমানে বাজারে প্রতি কেজি ৮ থেকে সাড়ে ৮ টাকায় আলু বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ প্রতি কেজিতে ১৫ টাকা লোকসান তার। চলতি বছর এক হাজার বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করে ৯ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে হারুনুর রশিদের।

অন্যদিকে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর এক কেজি আলু উৎপাদনে তাদের খরচ হয়েছে ১০ থেকে ১৩ টাকা। এরপর বাছাই, বস্তাবন্দি, পরিবহন, শ্রমিক মজুরি ও হিমাগার ভাড়াসহ মোট ব্যয় দাঁড়িয়েছে প্রতি কেজিতে প্রায় ২৩ টাকা। কিন্তু সংরক্ষণের পাঁচ মাস পর বর্তমানে বাজারে সেই আলু বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৭ থেকে ৮ টাকা দরে। ফলে প্রতি কেজিতে কৃষক ও ব্যবসায়ীদের প্রায় ১৫ টাকা করে লোকসান গুনতে হচ্ছে।

উপজেলার আলুচাষি ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বছর এই এলাকায় প্রচুর পরিমাণ আলু উৎপাদন হয়েছে। দাম বাড়ার আশায়  হিমাগারে আলু সংরক্ষণ করেছিলেন তারা। কিন্তু এখন শুরু মৌসুমের তুলনায় অনেক কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। প্রতি কেজিতে পাচ্ছেন ৭ থেকে ৮ টাকা। অথচ বিগত বছর গুলোতে ৪০ টাকা পর্যন্ত দরে আলু বিক্রি করে লাভবান হয়েছিলেন। এ বছর ক্ষেত থেকে শুরু করে হিমাগার পর্যন্ত ব্যাপক লোকসান হয়েছে। সরকারের আলু কেনার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন না হওয়ায় হতাশা আরও বেড়েছে বলে জানান তারা। এভাবে চলতে থাকলে আগামী মৌসুমে আলু চাষে অর্থ সংকটে পড়বেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন চাষিরা।

উপজেলা কৃষি দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগের বছর এই উপজেলায় প্রায় ৫ হাজার ৯২০ হেক্টর জমিতে আলু উৎপাদন হয়েছিল। এই বছর আলু উৎপাদন হয়েছে প্রায় ৬ হাজার ৬শ হেক্টর জমিতে। গত বছরের তুলনায় ৬৮০ হেক্টর জমিতে এবার বেশি আলু চাষ হয়েছে। এবার মোট উৎপাদিত আলুর পরিমাণ প্রায় ১ লাখ ৩০ হাজার টন। অতিরিক্ত উৎপাদনের কারণে বাজারে সরবরাহ বাড়ায় দাম দরপতনের মূল কারণ।

হিমাগারে পড়ে আছে ৯২ হাজার বস্তা আলু : এই উপজেলার গোপীনাথপুর হিমাগার ও দীনা কোল্ড স্টোরেজ নামে দুটি হিমাগারে বর্তমানে প্রায় ৯২ হাজার বস্তা আলু মজুত রয়েছে। প্রতি বস্তা ৬০ কেজি করে মোট পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৩৮ হাজার মণ। প্রতি মণে ৬০০ টাকা লোকসান ধরলে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৮ কোটি ২৮ লাখ টাকা। বাজারে আলুর দরপতনের কারণে কৃষক ও ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু তুলতে পারছেন না। ফলে কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়েছে। আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে আলু উত্তোলনের জন্য মাইকিং করলেও তেমন সাড়া মিলছে না বলে জানিয়েছে হিমাগার কর্তৃপক্ষ।

বাণিজ্য উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি : বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির উদ্দিন গত ৫ সেপ্টেম্বর আকস্মিকভাবে আক্কেলপুর উপজেলার গোপীনাথপুরে সফরে এসে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, এ বছর দেশে প্রচুর আলু উৎপাদিত হয়েছে এবং আগামী এক মাসের মধ্যে এর দাম কিছুটা বাড়তে পারে। তিনি বলেন, সরকার আলু রপ্তানিতে প্রণোদনা দিচ্ছে, টিসিবির মাধ্যমে বাজার থেকে আলু ক্রয়ের পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছে। কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ সুরক্ষায় হিমাগার গেটে আলুর সর্বনি¤œ মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিন্তু কৃষক ও ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেছেন, এই প্রতিশ্রুতি এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

কৃষকদের লোকসান :

উপজেলার ভিকনী গ্রামের কৃষক বিপ্লব হোসেন রূপালী বাংলাদেশেকে এই সংকটের বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন। বিপ্লব ২২ বিঘা জমিতে আলু চাষ করে ২ হাজার ২ শত ৪০ মণ আলু উৎপাদন করেছেন। মোট খরচ হয়েছে ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। সরকারের আলু কেনার ঘোষণার পর দাম বাড়ার অপেক্ষায় আলু বিক্রি বন্ধ রাখেন। কিন্তু সরকারিভাবে আলু না কেনায় বাজারে আলুর দামে ধস নামে। এখনো তার দেড় হাজার বস্তা আলু এখনো হিমাগারে রয়েছে।

তিনি বলেন, বাণিজ্য উপদেষ্টা বলেছিল সরকারিভাবে আলু কেনা হবে। কিন্তু একটি আলুও কেনা হয়নি। মনে করেছিলাম সরকার কিনলে কিছুটা লোকসান পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তাই হিমাগার থেকে আলু উত্তোলন করিনি। এখন লোকসান পাহাড়সম হয়েছে।

আক্কেলপুরের কৃষক আবু বক্কর সিদ্দিক ১০ বিঘা জমিতে ডায়মন্ড ও স্টিক জাতের আলু চাষ করে প্রায় ১ হাজার মণ উৎপাদন করেন। মৌসুমের শুরুতে ৭৫০ মণ আলু বিক্রি করে ৯০ হাজার টাকা লোকসান হয় তার। হিমাগারে রাখা ২৫০ মণ আলুতেও দরপতনে আরও প্রায় ২ লাখ টাকা ক্ষতি গুনতে হচ্ছে।

উপজেলার গোপীনাথপুর হিমাগারে ব্যবস্থাপক রবিউল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশেকে বলেন, বাজারে আলুর দরপতনের প্রভাব আমাদের হিমাগারেও পড়েছে। কৃষক ও ব্যবসায়ীদের ব্যপক লোকসান হয়েছে। এ দিকে আমাদের সংরক্ষণের সময় ফুরিয়ে আসছে। আমরা এলাকায় মাইকিং ও বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আলু উত্তোলন করার জন্য তাগাদা দিচ্ছি। এখনো বিপুল পরিমাণ আলু হিমাগারে রয়েছে।

জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মেহেদী হাসান জানান, এ বছর উৎপাদন বেশি হওয়ায় বাজারে সরবরাহ বেড়েছে। সরকারিভাবে ২২ টাকা কেজি দরে আলু কেনার সিদ্ধান্ত হলেও নির্দেশনা না আসায় তা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। রপ্তানি ও বিকল্প বাজার তৈরিতে কাজ চলছে।