ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য ২৩৭ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করেছে বিএনপি। সেখানে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৬ আসন কোনো প্রার্থিতা ঘোষণা করেনি দলটি। ধারণা করা হচ্ছে, বিএনপি তাদের যুগপৎ আন্দোলনের জোটসঙ্গী গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকিকে আসনটি ছাড় দিবে। গণসংহতি আন্দোলনও এই আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে সাকিকে। কিন্তু জোনায়েদ সাকির দলীয় প্রতীক ‘মাথাল’ নিয়ে নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া অনেক কঠিন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ মাথাল প্রতীক সাধারণ মানুষের কাছে অনেকটাই অপরিচিত। এ প্রসঙ্গে জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য একটা অপরিহার্য ব্যাপার। সংস্কার বাস্তবায়ন করতে হলে আবশ্যিকভাবে নির্বাচন লাগবে।’ তিনি বলেন, ‘গণসংহতি আন্দোলনের প্রার্থীরা নিজ দলীয় প্রতীকেই নির্বাচন করবেন। কিন্তু কোনো দল যদি কোনো জোটের প্রতীকে নির্বাচন করতে চায়, সেই সুযোগটা রাখাও আমরা সমীচিন মনে করি।’
একইভাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও সংশোধন করে জাতীয় নির্বাচনে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচন করলেও প্রার্থীকে নিজ দলের প্রতীকে নির্বাচন করতে হবেÑ নির্বাচন কমিশন থেকে এমন সিদ্ধান্ত আসায় ঝুঁকে পড়তে যাচ্ছেন বিভিন্ন দলের অন্তত অর্ধশতাধিক প্রার্থী। ছোট এসব দলের নেতারা বিএনপিসহ বিভিন্ন জোটের হয়ে যে প্রতীক জনপ্রিয় সেই প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী। বিগত কয়েক নির্বাচনেও জনপ্রিয় প্রতীক ধানের শীষ ও নৌকা নিয়ে তাদের জোটসঙ্গীরা নির্বাচন করেছিলে। ত্রয়োদশ নির্বাচনকে সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে এমন সিদ্ধান্ত আসায় নাখোশ বিএনপিসহ তাদের জোটের মিত্ররা। তারা বলছেন, বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটকে টার্গেট করেই এমন নিয়ম করা হয়েছে। বিএনপি ও তার জোটসঙ্গী ১২দলীয় জোটসহ অনেক দলই জোটবদ্ধ দলগুলোর নিজের ইচ্ছামতো জোটের প্রতীকে নির্বাচন করার সুযোগ বহাল রেখে আরপিও-এর ২০ অনুচ্ছেদের পূর্বের বিধান বহাল রাখার জন্য ইসিকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আব্দুল রহমানেল মাছউদ বলেছেন, ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়েই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছে। এটি সরকারও গ্রহণ করেছে। তাই এখন আর ভিন্ন কোনো চিন্তা আমরা করছি না।’
যদিও মাঠের আলোচিত আরো দুটি দল জামায়াতে ইসলাম ও জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নির্বাচন কমিশনের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ নাগরিকরা পক্ষে-বিপক্ষে মত দিয়েছেন। কেউ কেউ বলছেন, আরপিও সংশোধন একটি ভালো উদ্যোগ। এতে ছোট ছোট দলের নেতারা রাজনীতি করতে হলে জনগণের কাছে যেতে হবে। নিজ দলের প্রতীককে সাধারণ মানুষের কাছে জনপ্রিয় করতে হবে। শুধু ঢাকায় বসে বক্তব্য-বিবৃতি, ঘরোয়া সমাবেশ আর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মনববন্ধন করে আখের গোছানোর দিন শেষ হয়ে যাবে। আবার কেউ কেউ বলছেন, জোট করলে জনপ্রিয় প্রতীকে নির্বাচন করতে সুযোগ দেওয়া উচিত। কারণ জোটের নেতাকর্মীরা হয়তো ভোটের মাঠে সহায়তা করবেন তবে প্রতীক চেনানো কঠিন হয়ে পড়বে।
জানা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের আলোচনায় প্রতীকের বিষয়টি না এলেও সরকার কর্তৃক গঠিত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ থেকেই নির্বাচন কমিশন প্রস্তাবটি গ্রহণ করেছে। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বা আরপিও (সংশোধন) অধ্যাদেশ অনুমোদনের পর গত সোমবার আইন মন্ত্রণালয় অধ্যাদেশটি গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এরপর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও তার নেতাদের বিচার কার্যসম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত দলটির যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এতে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশগ্রহণ করতে পারবে না বলে জানিয়েছে ইসি। ফলে বর্তমানে মাঠে বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম ও এনসিপি অন্যতম প্রধান দল। এই তিন দলকে কেন্দ্র করে হতে পারে নির্বাচনি জোট। জোটের আলোচানায় শীর্ষে রয়েছে বিএনপি ও জামায়াত।
সম্প্রতি ২৩৭টি আসনে তাদের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করে বিএনপি। আরও কয়েকটি আসনে দলটি তাদের প্রার্থী দিতে পারে। দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, বিএনপি অন্তত ৫০টি আসন তাদের জোটসঙ্গীদের ছাড় দিতে পারে। এরই মধ্যে অনেক প্রার্থীকে ছাড় দেওয়ার বিষয়টি জানিয়েও দেওয়া হয়েছে। জোটের অধিকাংশ প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
এর বাইরে জামায়াত ও এনসিপি বিভিন্ন দল নিয়ে জোট করলেও দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী। তারা আরপিওকে স্বাগত জানিয়েছেন। এ ছাড়াও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বামপন্থি দলগুলোকে নিয়ে সিপিবি-বাসদের নেতৃত্বে জোটসহ আরও কয়েকটি জোট হতে পারে। সেসব অনেক দলের নিবন্ধন না থাকায় তারা বড় দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করতে আগ্রহী।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটে থেকে নির্বাচন করতে আগ্রহী ববি হাজ্জাজের এনডিএম। তার দলীয় প্রতীক সিংহ হলেও তারা চান বিএনপির প্রতীকে অংশ নিতে। দলটির মহাসচিব মোমেনুল আমিন বলছেন, ‘নির্বাচন কমিশন দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করেছে। বিএনপির নেতৃত্বে বড় জোট হচ্ছে। এই জোটকে ঠেকানোর জন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা দলের প্রেসক্রিপশনে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।’
নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলছেন, ‘পরিবর্তনটা কেন আনা হয়েছে সেই ব্যাখ্যা তারা পাননি। জোটের প্রতীকে ভোট করলে সুবিধা হয়। আবার নিজের আইডেন্টিটি তৈরি করতে অসুবিধা। দুটো দিকই আছে। আমরা আলোচনা করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাব।’ তিনিও বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট থেকে নির্বাচন করবেন বলে জনশ্রুতি আছে।
গণফোরামের নির্বাহী সভাপতি অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, ‘নতুন যে বিধান করা হয়েছে আমরা তা মানি না। আগে যে নিয়ম ছিল সেই নিয়ম ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা সবাই মিলে নির্বাচন কমিশনে যাব।’
জাতীয় পার্টির (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, ‘আমরা মনে করি, জোট গঠনের মূল উদ্দেশ্য নির্বাচনে জয়ী হওয়া। জোটবদ্ধ দলগুলোর পছন্দ অনুযায়ী প্রতীক চাওয়ার অধিকার আছে। এভাবেই এতদিন প্রতীক বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং এতে কোনো সমস্যা হয়নি। এই প্রচলিত পদ্ধতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা কেন দেখা দিল, তা আমাদের বোধগম্য নয়। তা ছাড়া নির্বাচনের প্রধান অংশীজন অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কোনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা ছাড়াই এমন একটি বড় সিদ্ধান্ত গ্রহণ অনভিপ্রেত এবং আমাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য।’
বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ইসমাইল জবিউল্লাহ বলেন, ‘জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি কিংবা নির্বাচন করার অধিকার থাকলে রাজনৈতিক দলগুলোর ইচ্ছে অনুযায়ী নিজ দল কিংবা জোটবদ্ধ যে কোন দলের প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করাও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। সে অধিকার ক্ষুণœ করার কোনো সুযোগ আছে বলে বিএনপি মনে করে না। তাই আমরা আরপিওতে ২০ অনুচ্ছেদের পূর্বের বিধান বহাল রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ করেছি।’
তবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলছেন, ‘কোনোভাবেই সংশোধিত বিধান পরিবর্তন করা যাবে না। জোটে ভোট করলেও স্ব স্ব দলের প্রতীকে ভোট করতে হবে।’
এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম একটি চিঠিতে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছেন, ‘আমরা মনে করি, প্রতিটি নিবন্ধিত দলকে তাদের নিজস্ব প্রতীকে নির্বাচন করার যে সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশন নিয়েছে তা একটি ঐতিহাসিক ও নীতিগতভাবে সঠিক পদক্ষেপ।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটে থেকেও জাতীয় পার্টি তাদের লাঙ্গল প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করেছিল। আবার ওই নির্বাচনসহ ২০২৪ পর্যন্ত পরের সব নির্বাচনেই আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিলেন রাশেদ খান মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি ও হাসানুল হক ইনুর জাসদের প্রার্থীরা। আবার ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটে থেকে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থীরা বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করেছিল। তবে জামায়াতে ইসলামী সেই নির্বাচনে তাদের দলীয় দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়েই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল। ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলীয় জোটের প্রার্থীরা নৌকা আর বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট প্রার্থীরা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন।
এতদিন জোটবদ্ধ দলগুলো নিজেরা নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে জানাত যে, তারা জোটের প্রতীকে নির্বাচন করতে চান। আবার জোট থেকেও প্রতীক নিয়ে একটি চিঠি কমিশনকে দেওয়া হতো। ফলে জোটের প্রতীক নিয়ে যেমন নির্বাচনে অংশ নেওয়া যেত, তেমনি জোটবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল।

