গণহত্যার অপরাধে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায় আগামীর রাজনীতিবিদদের জন্য সতর্কবার্তা। এর ফলে ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিশ্চিহ্ন করা কিংবা ক্ষমতার প্রয়োজনে রাজনীতিবিদদের নিষ্ঠুর হওয়া থকে বিরত রাখবে, যা আগামী রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করবে। তবে সুষ্ঠু রাজনীতির স্বার্থে সহনশীল ও সহাবস্থানের পরিবেশ তৈরি করতে হবে রাজনৈতিক দলগুলোকেই। তার পরও কিছু রাজনৈতিক দল হয়তো ক্ষমতার লোভে এই সতর্কবার্তা মনে রাখবে না। রাজনীতি বিশ্লেষক ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে কথা বলে এমন ধারণা পাওয়া গেছে।
স্বৈরশাসকের মতো দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদ- দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। দেশের সাবেক কোনো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এমন রায় দেশের ইতিহাসে এটিই প্রথম।
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই রায় আগামী দিনের রাজনীতিবিদদের জন্য একটি গভীর ও শক্তিশালী সতর্কবার্তা, যা রাজনৈতিক ক্ষমতা, দায়বদ্ধতা এবং শাসনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে এক নতুন অধ্যায় হিসেবে হাজির হয়েছে। কিছু দল এবং আইনজ্ঞরা বলছেন, এই রায় ইতিহাসের দৃষ্টান্ত, যা রাজনৈতিক নেতা ও ক্ষমতাসীন নেতাদের জন্য এক স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে যে, শাসনকালের সময়ে তাদের কর্মকা- বিচারের আওতায় আসতে পারে। একনায়কতন্ত্র বা ক্ষমতার অপব্যবহার আর কোনো ক্ষেত্রে অবাধ ছাড় পাবে না। এই রায় আগামীতে রাজনৈতিক আচার-আচরণ ও ক্ষমতার ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে নজির তৈরি করতে পারে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই রায় আন্তর্জাতিকভাবে আইনি ও রাজনৈতিক প্রভাব দেখাবে যে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতার ব্যবহার সীমাহীন নয় এবং ভবিষ্যতে অন্যান্য রাজনীতিবিদের জন্য আন্তর্জাতিক নজরদারির সম্ভাবনাও শক্ত হতে পারে।
ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে এ রায়ের প্রভাব কেমন হবে? ক্ষমতার দৌড়ে পরিবর্তন আনবে কি নাÑ এই প্রশ্নের জবাবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, কঠিন হবে আগামীর রাজনীতি। তবে ক্ষমতা তাদের অন্ধ করে ফেলে। তাই এই অন্ধত্ব থেকে বের হতে না পারলে রাজনীতির পরিবেশ উন্নত হবে না।
সিপিবির সাবেক সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স এ বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাজনীতিবিদেরা ক্ষমতার মোহে সবকিছু ভুলে যান। ফলে তারা হয়তো এই সতর্কবার্তা মনে রাখবেন না। তবে শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায় থেকে প্রত্যেক রাজনীতিবিদের শিক্ষা নেওয়া উচিত এবং তাদের দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে বিচার হয় রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন নিজেদের মতো করে বিচার কার্য পরিচালনা করে। আর ক্ষমতার পালাবদলের পর সেই রায় পাল্টে যায়। তবে শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-ের রায়ের ক্ষেত্রে সঠিক বিচার হয়েছে। সে যেভাবে হত্যার রাজনীতি করে ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছিল, তাই তার বিচার হওয়াটা জরুরি ছিল। তবে এই বিচারকাজে আরও স্বচ্ছতা ও আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখা যেত। প্রধান প্রসিকিউটর ও বিদেশি আইনজীবী নিয়ে যে প্রশ্ন আছে, তা দূর করার জন্য অন্য কারো নিয়োগ দেওয়া যেত।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই রায় রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে নতুন করে প্রশ্ন রেখেছেÑ একনায়কবাদ-মনোভাবে ক্ষমতা আয়ত্ত করা বা রাজনৈতিক নেতা হয়ে কেবল নির্বাচনে জয়লাভ করাই যথেষ্ট নয়, তাদের দায়বদ্ধতা ও ন্যায়নিষ্ঠ পরিচালনা অবশ্যই থাকতে হবে। ভবিষ্যতে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের নেতাদের পরিচালনায় গঠনশীল ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করার দিকে এগোতে হতে পারে। এই রায় দেখিয়েছে যে, বিচারব্যবস্থা শক্তিশালী হলে রাজনীতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে শাসনব্যবস্থার অনিয়ম, অদক্ষতা বা ক্ষমতার সীমালঙ্ঘনকে মোকাবিলা করা সম্ভব। তাই নেতাদের উচিত বিচার সংস্থাগুলোর স্বাধীনতা রক্ষা, বিচার প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং আইনগত সংস্কারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের অধ্যাপক আশরাফুল ইসলাম চৌধুরী এবং শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সাজ্জাদ এইচ সিদ্দিকীর মতে, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিহিংসা সরিয়ে প্রতিযোগিতা তৈরি হওয়া দরকার।’
সময়ের পরিবর্তনে রাজনীতিতে যে চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়, সেটিকে গ্রহণ করে রাজনৈতিক দলগুলোকে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তৈরি করা দরকার বলেও মন্তব্য করেন এ দুই বিশ্লেষক।
বিশ্লেষকেরা আরও বলছেন, এ রায় রাজনৈতিক উত্তেজনায় নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। কিছু নেতা তা ‘বিচার রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ বলে সমালোচনা করতে পারেন এবং এর মাধ্যমে রাজনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরও তীক্ষ্ণ হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, বিচার প্রক্রিয়ার ওপর নেতাদের এবং দলগুলোর ওপর যুক্তি প্রতিরক্ষা, আপিল ও আইনগত কৌশল চালানোর চ্যালেঞ্জ বাড়বে। কিছু নেতা আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে নিজেদের প্রস্তুত না রাখলে বিপদে পড়তে পারেন। যদি নেতারা এই রায়কে একটি বাস্তব শিখন হিসেবে নেন, তাহলে এটি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংস্কার ও দায়বদ্ধতার গতি বাড়াতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোতে অভ্যন্তরীণ নেতুত্ব মূল্যায়ন, যথোপযুক্ত তদারকি এবং স্বচ্ছতা বাড়তে পারে।
ধারণা করা হচ্ছে, বিচারব্যবস্থার প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরে আসতে পারে, যদি দেখানো যায় যে শাসিতদের বিরুদ্ধে দায়বদ্ধতা কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়। এটি দেশের আইনি শাসনব্যবস্থাকে মজবুত করার সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদ-ের রায় রাজনৈতিক মাত্রার একটি সাধারণ ঘটনা নয়। এ রায় রাজনীতিবিদদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, ক্ষমতা শুধু অধিকার নয়, একই সঙ্গে দায়। রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কর্মকা- শুধু বর্তমান সময়ের জন্য নয়, ইতিহাস ও ন্যায়বিচারের সামনে বিচার্য হবে।
রাজনীতিবিদদের উচিত এই রায়কে কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের পরাজয় হিসেবে না দেখা, বরং এটি থেকে শেখার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করা। দায় ও নেতৃত্ব একসঙ্গে চলার কথা, ক্ষমতা ব্যবহার এবং ন্যায় প্রতিষ্ঠার দায়বদ্ধতা অবশ্যই মনোযোগে রাখতে হবে। যদি এভাবে ভাবা যায়, তাহলে এই রায় ভবিষ্যতে রাজনৈতিক সংস্কার ও দায়বদ্ধতার নতুন অধ্যায় শুরু করতে পারে।

