বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন কিছু মুহূর্ত রয়েছে, যা একদিকে যেমন জাতির সম্মিলিত লজ্জা ও বেদনাকে স্মরণ করিয়ে দেয়, অন্যদিকে তেমনি নতুন এক সূচনার সম্ভাবনাও জাগায়। সম্প্রতি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও তার রায় ঠিক এমনই এক দ্বিমুখী বাস্তবতা। কয়েক বছর আগেও কেউ কল্পনা করেনি যে রাষ্ট্রশক্তির চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে থাকা একজন ক্ষমতাশালী শাসক মানবতাবিরোধী অপরাধে দ-িত হবেন। কিন্তু একটি ঐতিহাসিক গণ-অভ্যুত্থান সেই অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক বাস্তবতা সৃষ্টি করল। আর সেই পথ ধরেই সম্ভব হলো ন্যায়বিচারের দরজা খুলে দেওয়া।
বাংলাদেশের জনগণের ওপর দীর্ঘ সময় ধরে যে নিপীড়ন চালানো হয়েছে, তার কেন্দ্রে শুধু রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় স্বেচ্ছাচার, নিষ্ঠুরতা ও মানবধিকার লঙ্ঘনের ধারাবাহিকতা ছিল। নিখোঁজ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, পুলিশি নির্যাতন, গায়েবি মামলা, বিরোধী মতের ওপর দমন-পীড়ন সব মিলিয়ে রাষ্ট্র কার্যত নাগরিকদের বিরুদ্ধে পরিণত হয়েছিল এক ভয়ংকর যন্ত্রে। গণতান্ত্রিক মনোভাবের অবক্ষয়, সাংবিধানিক ব্যত্যয় এবং বিচার ব্যবস্থার ওপর নির্বাহী বিভাগের অভিযোজন, সবকিছু মিলে বাংলাদেশে এক বিশেষ ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।
এ পরিস্থিতির চূড়ান্ত রূপ দেখা যায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময়, যখন নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে মারণাস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ দেওয়া হয়। সেই নির্দেশের ফরেনসিকভাবে যাচাইকৃত অডিও আজ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচিত। আল জাজিরা এবং বিবিসির মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম নিজেদের ল্যাবে অডিওর সত্যতা যাচাই করে দেখিয়েছে, নির্দেশকারী কণ্ঠটি শেখ হাসিনারই। এ প্রমাণ শুধু নৈতিকভাবে নয়, আইনি ক্ষেত্রেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এ প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায় নিঃসন্দেহে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ। পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটিতে শেখ হাসিনার মৃত্যুদ-াদেশ এবং দুটিতে আমৃত্যু কারাদ- কোনো সহজ সিদ্ধান্ত নয়। বরং এটি রাষ্ট্রের ন্যায়বিচারের প্রতি প্রতিশ্রুতি ও জনমতের প্রতিফলন। নিহতদের পরিবার, আহতরা, শারীরিকভাবে পঙ্গু হয়ে যাওয়া মানুষ, আগুন-সন্ত্রাসে সব হারানো নাগরিক সবাই এ রায়ের মাধ্যমে কিছুটা হলেও শান্তি পেয়েছেন। তারা জানেন, অন্তত ইতিহাসের আদালতে সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তবে এর বাইরেও এ রায়কে বড় করে তোলার আরেকটি কারণ আছে, দীর্ঘ ১৫ বছরের শাসনামলের গণতন্ত্রবিরোধী কর্মকা-, বিরোধীদলকে নির্মূল করার প্রচেষ্টা, গণমাধ্যমের ওপর দমন, বিচারব্যবস্থাকে প্রভাবিত করা, এবং নাগরিক অধিকারের ধারাবাহিক লঙ্ঘন। বিশেষ করে অবৈধভাবে ক্ষমতায় থাকা দীর্ঘ সাড়ে দশ বছর ধরে যেসব অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, সেগুলো সরাসরি মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় পড়ে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারটি কেবল জুলাই হত্যাযজ্ঞের জন্য নয়, বরং একটি পুরো সময়ের দায়বদ্ধতার প্রতিফলন।
কিন্তু এতকিছুর পরও জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে, এ রায় কার্যকর হবে কি? শেখ হাসিনা বর্তমানে ভারতের সুরক্ষায় থাকায় তাকে বাংলাদেশে ফেরত আনার সম্ভাবনা খুবই কম। ভারত যেভাবে তাকে ব্যবহার করছে এবং যেভাবে তার উসকানিমূলক বক্তব্য প্রচারে কোনো বাধা দিচ্ছে না, তা ইঙ্গিত দেয় যে ভারত তাকে রাজনৈতিক সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করছে।
এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে প্রত্যাশা কম। জাতিসংঘ ও পশ্চিমা বিশ্বের বড় অংশ মৃত্যুদ-বিরোধী অবস্থানে থাকায় তাদের থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে চাপ দেওয়া কঠিন। তবে এর মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ সরকারের হাত বাঁধা। ভারতের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার প্রয়োজনীয়তা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি। ভারত যদি সত্যিই বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক চায়, তবে তাদের উচিত হবে শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে শত্রুভাবাপন্ন অবস্থান গ্রহণ থেকে সরে আসা। আন্তর্জাতিক রাজনীতি কখনো একপাক্ষিক থাকে না, এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাও বদলায়Ñ ভারতেরও তা বুঝতে হবে।
আরেকটি দিক হলো আন্তর্জাতিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রশ্ন। আন্তর্জাতিক অপরাধে অনুপস্থিতিতে বিচার সাধারণত গ্রহণযোগ্য নয়। রোম স্ট্যাটিউটেও অভিযুক্তের অনুপস্থিতিতে বিচার পর্ব পরিচালনার সুযোগ নেই। তবে বাংলাদেশের সরকার যে সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনকে দিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করানো, তা আন্তর্জাতিক মহলের চোখে বিচারকে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে। তদন্তে স্পষ্ট বলা হয়েছে, মানবতাবিরোধী অপরাধের পরিকল্পনা, সিদ্ধান্ত ও তদারকির কেন্দ্রে ছিলেন শেখ হাসিনা।
এমন প্রমাণ আন্তর্জাতিক চাপ প্রতিহত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বড় সহায়ক শক্তি।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট হলোÑ শেখ হাসিনার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। রায় কার্যকর হোক বা না হোক, তার ফের রাজনীতিতে ফিরে আসার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। বয়স, পরিস্থিতি, জনপ্রতিক্রিয়া, অভ্যুত্থানের পর দলীয় বিভাজন, সব মিলিয়ে এ রায় তার রাজনৈতিক অধ্যায়কে সমাপ্ত করেছে।
আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে দল হিসেবে তাদের বিচার হওয়ার সম্ভাবনা আলোচনায় আছে। সেই বিচার না হলেও শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে দলের নেতৃত্ব পুনর্গঠন বা পুনঃপ্রতিষ্ঠা বাস্তবসম্মত নয়। আরও বড় সমস্যা দলের সমর্থকদের মধ্যে এখনো বিভ্রান্তি ও বাস্তবতা অস্বীকারের প্রবণতা। তারা এখনো উপলব্ধি করতে পারছে না দলটির নেতৃত্ব কী ভয়াবহ অপরাধ করেছে। তবে এই রায় তাদের মনে নতুন প্রশ্ন জাগাবে, এটাই আশা।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মূল সত্য হলো, ন্যায়বিচারের অভাব সমাজে অনিয়ম, উগ্রতা ও সহিংসতার জন্ম দেয়। মানুষ রাষ্ট্র সৃষ্টি করেছিল নিরাপত্তা, অধিকার ও ন্যায়ের নিশ্চয়তা পাওয়ার জন্য। কিন্তু যখন রাষ্ট্রই মানবতাবিরোধী অপরাধে লিপ্ত হয়, তখন সেই রাষ্ট্রের নৈতিক বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
শেখ হাসিনার বিচার সেই নৈতিক বৈধতার পুনর্গঠনের একটি প্রথম ধাপ। রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের আস্থা ভেঙে গেলে তা পুনর্গঠনের জন্য কঠোর নীতিগত ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এই রায় সেই পুনর্গঠনের পথে একটি মৌলিক ভিত্তি রচনা করেছে।
মার্টিন লুথার কিং-এর সেই বিখ্যাত উক্তি আজ আবারও প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি বলেছিলেন ‘যেকোনো অবিচারই সব ক্ষেত্রে ন্যায়বিচারের জন্য হুমকি।
বাংলাদেশ বহু বছর ধরে অবিচারের গভীর অন্ধকারের মধ্যে ছিল। আজকের এ রায় সেই অন্ধকার ভেদ করার সাহসী চেষ্টা। এটি নিছক প্রতীকী নয়। এটি রাষ্ট্র ও সমাজের কাছে এক নৈতিক বার্তা। ন্যায়বিচার শুরু হয়েছে, এবং তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এখন সরকারের দায়িত্ব।
যদিও এই বিচারপ্রক্রিয়া অনেকসময় রাজনৈতিক বিতর্ক বা আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে, তবুও ন্যায়বিচারের পথ দীর্ঘ হলেও তা অপরিহার্য। বিচার যাতে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদ- অনুযায়ী হয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রকে সবসময় সতর্ক থাকতে হয়। রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে বিচার নিশ্চিত করলেই এটি টেকসই হতে পারে।
অতীতের অন্ধকারকে স্বীকার করে সেই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসাই একটি সভ্য জাতিতে পরিণত হওয়ার চিহ্ন। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামালের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার সেই পরিণতির নতুন পথ দেখালো, যা অতীতকে শোধরাবে বলে বিশ^াস করি সেই সঙ্গে বর্তমানকে স্থিতিশীল করে এবং ভবিষ্যৎকে নিরাপদ করবে। তাই এ বিচার শুধু আদালতের চার দেয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি রাষ্ট্রের নৈতিক পরিচয় পুনর্নির্মাণ ও নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে।
শেখ হাসিনার বিচার কেবল একজন ব্যক্তির বিচার নয়, এটি পুরো একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিচারের সূচনা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, কর্তৃত্ববাদ, ক্ষমতার অপব্যবহার এসবের বিরুদ্ধে জনগণের নৈতিক শক্তিই শেষ পর্যন্ত জিতেছে।
এখন প্রয়োজন দ্বিতীয় ধাপ। প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্গঠন করা। কারণ ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা একদিনের কাজ নয়; এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া।
এ রায় সেই প্রক্রিয়ার প্রথম সোপান। এখন রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে সেই যাত্রাকে অমোঘ ও টেকসই করে তোলার।

