- হাওড়াঞ্চলের ৫ জেলার ১০ উপজেলায় হচ্ছে হোস্টেলের সুবিধাসহ ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়
- সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের অর্থায়নে ৫২০ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয়েছে প্রকল্প
- ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরে
- আবাসিক সুবিধা থাকলে হাওড়াঞ্চলে কমবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর হার
দেশের হাওড়াঞ্চল বছরের প্রায় অর্ধেক সময় ডুবে থাকে পানিতে, বাকি অর্ধেক সময় শুকনো। এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচলিত আছে একটা প্রবাদÑ ‘বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও’ অর্থাৎ, বর্ষাকালে নৌকা আর হেমন্তকালে পায়ে হাঁটা। এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এই প্রবাদবাক্য যেন বেশি মানায়। বর্ষায় বিদ্যালয়গুলোর চারদিকে থাকে অথৈ জল আর শুকনো মৌসুমে হেঁটে পাড়ি দিতে হয় কয়েক কিলোমিটারের ধু-ধু মাঠ। শুকনো মৌসুমে কষ্ট করে প্রায় সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী স্কুলে গেলেও বর্ষার কয়েক মাস কমে যায় উপস্থিতি। অনেক সময় বিদ্যালয় বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় বন্ধ থাকে শিক্ষা কার্যক্রম। যাতায়াতসহ নানা সংকটে হাওরাঞ্চলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও অনেক। এমনটাই ভাষ্য স্থানীয় বাসিন্দাদের। এসব কথা বিবেচনা করে হাওড়াঞ্চলের পাঁচ জেলার ১০ উপজেলায় ছাত্র-ছাত্রীদের হোস্টেলের সুবিধাসহ ১০টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যেগ নিয়েছে সরকার। এ জন্য সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের (এসএফডি) অর্থায়নে ৫২০ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরে।
সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা পারভীনের সভাপতিত্বে হাওড়াঞ্চলে ১০ মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন নিয়ে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের একটি সভা করেছেন। সভা সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। স্থানীয় শিক্ষাবিদরা বলছেন, আবাসনসুবিধাসহ স্কুল প্রতিষ্ঠার বিষয়টি খুবই ভালো উদ্যোগ। ছাত্র-ছাত্রীদের পৃথক হোস্টেলসহ স্কুলগুলো চালু হলে হাওড়ের দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা আবাসিক সুবিধাসহ লেখাপড়া করতে পারবে। এতে হাওড়াঞ্চলে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার সংখ্যাও কমে আসবে।
স্থানীয় বাসিন্দা ও শিক্ষানুরাগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বর্ষায় স্কুলে যাওয়ার জন্য সব পরিবারের নৌকা নেই, আবার নৌকা থাকলেও স্কুলে নিয়ে আসার জন্য পরিবারে লোক থাকে না। এ ছাড়া বর্ষায় বজ্রপাত ও নৌকাডুবিসহ নানা ভয়ে অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে আসে না। ফলে শিখনঘাটতিতে পড়ে অনেক শিক্ষার্থী। এর প্রভাব পড়ে পাবলিক পরীক্ষায়। ফলাফল খারাপ হওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই ছেড়ে দেয় লেখাপড়া। এ ছাড়া এসব অঞ্চলের মানুষ অপেক্ষাকৃত দরিদ্র হওয়ায় সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে পরিবারের বাড়তি অর্থের জোগান দিতে তাদের বিভিন্ন কাজে লাগিয়ে দেয়।
সূত্রমতে, এই প্রকল্পের আওতায় কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন ও নিকলী, সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ, ধর্মপাশা ও মধ্যনগর, হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর এবং নেত্রকোনা জেলার খালিয়াজুড়ি উপজেলা সদরে একটি করে স্কুল নতুন করে প্রতিষ্ঠা করা হবে। প্রকল্পটির মধ্যে রয়েছে ৩০ একর ভূমি অধিগ্রহণ, ১০টি প্রতিষ্ঠানে সর্বমোট ১০টি পাঁচতলা একাডেমিক ভবন, সাতটি চারতলা ছাত্রাবাস, সাতটি চারতলা ছাত্রীনিবাসসহ অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণ করা হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের সাতটি জেলার ৫৬টি উপজেলায় রয়েছে বিস্তীর্ণ হাওড় এলাকা। এই এলাকার শিক্ষার্থীরা আধুনিক, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মান উন্নয়নে হাওড় এলাকার ১০ উপজেলা সদরে ১০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে। সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্টের (এসএফডি) আর্থিক সহায়তায় ৬৪১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা প্রাক্কলিত ব্যয়ে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সম্প্রতি একটি বিনিয়োগ প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়। এই প্রকল্পে এসএফডি থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ সহায়তা পাওয়া যাবে বলেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। পরে একটি নিরপেক্ষ ও দক্ষ পেশাদার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি (সম্ভাব্যতা যাচাই) সম্পন্ন করে প্রকল্প দলিল পুনরায় পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর সমীক্ষা কার্যক্রম সম্পন্ন করে সমীক্ষা প্রতিবেদনের আলোকে প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সমীক্ষা প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে পাঁচটি স্থান পরিবর্তন, ব্যয় হ্রাস এবং ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেলের মোট সংখ্যা এবং শয্যাসংখ্যা কমিয়ে প্রকল্প দলিল পুনর্গঠন করা হয়েছে। পুনর্গঠিত ডিপিপি অনুযায়ী প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ৫২০ কোটি ২ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আগামী বছরের জানুয়ারিতে এই প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে শেষ হবে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরে।
এ প্রসঙ্গে সিলেট শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান রমা বিজয় সরকার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এটা নিঃসন্দেহে একটি ভালো উদ্যোগ। এতে হাওড় অঞ্চলে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমবে। অনেক শিক্ষার্থী আছে স্কুল থেকে অনেক দূরে বাড়ি। সেখান থেকে এসে পড়াশোনা করে। তারা যদি হোস্টেলে থাকার সুযোগ পায়, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হবে। আবার স্বল্প আয়ের অনেক পরিবারের শিক্ষার্থী আছে, যারা স্কুলের পাশে অন্যের বাড়িতে থেকে কিংবা ঘর ভাড়া দিয়ে থাকে। তাদের পড়াশোনার পথও সুগম হবে।’
এ প্রসঙ্গে শিক্ষা সচিব রেহানা পারভীন বলেন, ‘প্রকল্পটির কাজ শুরুর আগের প্রাকপ্রস্তুতি চলছে। প্রকল্পের কিছু বিষয়ে পরিবর্তনের সুপারিশ আসছে। ছাত্র/ছাত্রী হোস্টেল পরিচালনাসহ অন্যান্য বিষয় নিয়ে পর্যালোচনার জন্য শিগগিরই আরেকটি বৈঠক হবে। সেই বৈঠকে প্রকল্পটির কাঠামো চূড়ান্ত হলে বাকি কাজ শুরু হবে।’

