- পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা মিলছে না আন্তর্জাতিক অঙ্গনের
- দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ে
- চলতি বছর জানুয়ারি-নভেম্বরে জমা হয়েছে ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ। ২২৯৭ আসামির বিরুদ্ধে ৫৪১টি মামলা এবং ১২০৩ জনের বিরুদ্ধে ৩৪৯টি চার্জশিট দাখিল
দুর্নীতির মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে বছরে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে থাকে। মোটা অঙ্কের এসব অর্থ পাচারের জন্য দেশের দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, আর্থিক খাতের ক্রীড়নক, আমলারা জড়িত। ঘুষ-দুর্নীতি, আর্থিক অপরাধ, মিথ্যা ঘোষণার আড়ালে বাণিজ্য, ব্যাংক থেকে চুরি করা টাকা, খেলাপি ঋণের অর্থ, রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, কর ফাঁকিÑ এসব কর্মকা-ে অর্থ পাচারে গড়ে উঠেছে একটি চক্র। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, হংকং, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার হয়েছে দেশের টাকা। তবে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ফিরিয়ে আনতে সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা না পাওয়ায় পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা সম্ভব হচ্ছে না। দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহায়তা বৃদ্ধিসহ দেশের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি ও অর্থ পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রম জোরদারে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করা হয়। এই দিনে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে দুর্নীতি সচেতনতা বৃদ্ধি, স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা এবং নৈতিকতা প্রচার করা হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ওই বছরের ২৯ আগস্ট একটি শে^তপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করেন। ডিসেম্বরের শুরুতেই ওই কমিটি অর্থনীতি নিয়ে তৈরি শ্বেতপত্র প্রতিবেদনে বলা হয়, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ২৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলার বিদেশে পাচার হয়েছে। ডলারের দাম (প্রতি ডলারের দাম ১২০ টাকা) এর পরিমাণ ২৮ লাখ কোটি টাকা। এই হিসাবে প্রতিবছর গড়ে ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে বাংলাদেশেও আজ আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস পালন করা হবে। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা : গড়বে আগামীর শুদ্ধতা’Ñ এই প্রতিপাদ্য নিয়ে উদযাপন করা হবে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস-২০২৫। দিবসটি উপলক্ষে দুদক বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করবে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছেÑ দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন ধরনের পোস্টার, ব্যানার প্রদর্শন, সংগীত পরিবেশন, জাতীয় ও দুদকের পতাকা উত্তোলন, বেলুন-ফেস্টুন উড়ানো, গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময়, মানববন্ধন কর্মসূচি পালন।
দুদকের তথ্য মতে, দেশে প্রতিবছর ১৫ হাজার দুর্নীতির অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে হাজারখানেক অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য আমলে নেওয়া হয়। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১২ হাজারের বেশি অভিযোগ জমা হয়েছে। এই সময়ে দুই হাজার ২৯৭ জন আসামির বিরুদ্ধে ৫৪১টি মামলা দায়ের এবং এক হাজার ২০৩ জনের বিরুদ্ধে ৩৪৯টি চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। একই সময়ে দুদক সারা দেশে দুর্নীতিবিরোধী সচেতনতা বৃদ্ধিতে ২৩টি গণশুনানি করেছে। একই সময়ে সারা দেশে অনিয়ম, দুর্নীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে ৮৬৪টি অভিযান পরিচালনা করেছে। বিভিন্ন সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন কাজের অনিয়ম, কর্মকর্তাদের ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগে মোট অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে ৮৬৪টি। এসব অভিযান থেকেও ৩০টি মামলা দায়ের হয়েছে।
দুদকের তথ্য মতে, গত ৯ মাসে আদালতে ২৯৪টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১২৬টি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। সাজাপ্রাপ্তদের ৫ হাজার ৫৮ কোটি টাকা জরিমানা ও ৩২১ কোটি ৮৪ হাজার সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তবে গত ৯ মাসে বিদেশে পাচারকৃত কোনো অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারেনি। দুদক বিদেশে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে প্রায় ৪০টি এমএলআর পাঠিয়েছে। সব এমএলআরের জবাব পায়নি সংস্থাটি।
দুদকের ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের অক্টোবর পর্যন্ত কার্যক্রমের এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যে ১১ হাজার ৬৩০টি অভিযোগ জমা হয়েছে। এর মধ্যে দুদক ৯৬০টি অভিযোগের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মোট মামলা করা হয়েছে ৫১২টি, যার আসামির সংখ্যা ২ হাজার ১৯১ জন। এই ১১ মাসে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে ৪৩৫টি, যার আসামি সংখ্যা ৪৩৫ জন। দেশে-বিদেশে মোট সম্পদ ক্রোক হয়েছেÑ দেশে ৩৩৬১,২৯,৬৭,৮৯১ টাকা ও বিদেশে ৯৬,৫৩,৮০,০২৫ টাকা। অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ বা অবরুদ্ধ করা হয়েছে। দেশে ২২২,২৬,৭৯,৩২,৬০৬ টাকা ও বিদেশে ২৫১,৩৭,৩৩,৭৯৯ টাকা অবরুদ্ধ করা হয়েছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি পাচার হয়ে থাকে। গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে গড়ে বছরে প্রায় ৮ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার বা বর্তমান বিনিময় হারে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ পাচার হয়েছে। এর বড় অংশ চলে গেছে বাণিজ্যভিত্তিক ভুয়া বা মিথ্যা ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে দাম কম বা বেশি দেখিয়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অর্থ পাচার গত কয়েক বছরে আরও বেড়েছে। টিআইবি সর্বশেষ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে তাতে বলা হয়েছেÑ বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী প্রায় ১ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা অবৈধভাবে বিদেশে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের বড় অংশ যায় ভুয়া আমদানি-রপ্তানি বিলিং, শেল কোম্পানি ও অফশোর অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে, হুন্ডি ও অবৈধ রেমিট্যান্স চ্যানেল, নামমাত্র বিনিয়োগ দেখিয়ে বিদেশে সম্পদ কেনার মাধ্যমে।
সরকারি সূত্র ও আন্তর্জাতিক প্রতিবেদনে উঠে আসে, বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ সবচেয়ে বেশি গেছেÑ যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত (দুবাই), সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, সুইজারল্যান্ড ও ট্যাক্স হ্যাভেন হিসেবে পরিচিত ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস, কেম্যান আইল্যান্ডস ও বাহামা দ্বীপে শেল কোম্পানিতে।
দুদকের তথ্য বলছে, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা বিশ্বের সব দেশের জন্যই সবচেয়ে কঠিন ও দীর্ঘ প্রক্রিয়া। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনতে কয়েকটি ধাপ অনুসরণ করতে হয়। এগুলো হলোÑ বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, দুদক ও এনবিআর পাচারকারীদের ব্যাংক হিসাব ও বিদেশি সম্পদের সম্পদ অনুসন্ধান, আন্তর্জাতিক আইনি সহযোগিতা হিসেবে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) বা পারস্পরিক আইনি সহায়তার মাধ্যমে ব্যাংক রেকর্ড ও দলিল সংগ্রহ করা হয়। তার যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, বিদেশি আদালতে মামলা করে সম্পদ ফ্রিজ ও বাজেয়াপ্ত করার চেষ্টা করা হয় এবং বাজেয়াপ্ত অর্থ বাংলাদেশ সরকারের অনুকূলে ফেরত পাঠানো হয় এবং রাষ্ট্রীয় তহবিলে যুক্ত করা হয়। বাংলাদেশে এখনো বড় অঙ্কের সফলভাবে উদ্ধারের নজির নেই। তবে সরকারি সংস্থাগুলো জানিয়েছে, কয়েকটি হাইপ্রোফাইল মামলায় বিদেশে থাকা সম্পত্তির তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এবং আইনগত লড়াই চলছে।
দুদকের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস শুধুই অভিযোগ বা পরিসংখ্যান প্রকাশের দিন নয়। এটি মানুষকে সততা, নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা রক্ষার গুরুত্ব মনে করিয়ে দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দুর্নীতি রোধ এবং অবৈধ অর্থ দেশে ফেরত আনা ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক উন্নতি সম্ভব নয়। তাই বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে যে অর্থ গেছে, সেগুলো ফেরত আনার জন্য আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও আইনগত পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পদক্ষেপগুলোর কার্যকারিতা সীমিত এবং আরও শক্তিশালী নজরদারি প্রয়োজন।
দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম জানান, ব্যাপক উদ্দীপনার মাধ্যমে দিবসটি উদযাপনের লক্ষ্যে দুদক দিনব্যাপী বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকাল সাড়ে ৮টায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনা, জাতীয় পতাকা ও দুদক পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে। সকাল ৯টায় দুদক প্রধান কার্যালয়ের সামনে কর্মসূচির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হবে। পরে সকাল ১০টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটোরিয়াম অলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। একই সাথে বিভাগীয়, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও দিবসটি যথাযথভাবে উদযাপিত হবে।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন