ঢাকা বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অ্যান্টিবায়োটিকে বৈশ্বিক স্বাস্থ্যঝুঁকি

আসাদুজ্জামান খান মুকুল
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৪, ২০২৫, ০১:২৩ এএম

‘অ্যান্টিবায়োটিক’ শব্দটি এসেছে ‘এন্টি’ এবং ‘বায়োটিক’ শব্দের সমন্বয়ে, যার অর্থ হলো- জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকর ওষুধ। মানুষের বা পশুর শরীরে বিভিন্ন রকমের জীবাণু বাস করে এবং বাইরের পরিবেশ থেকেও জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। এর ফলে মানুষ বা পশু বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এই সমস্ত জীবাণুকে ধ্বংস বা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তা হলো অ্যান্টিবায়োটিক।

চিকিৎসকরা রোগের ধরন অনুযায়ী (বিশেষ করে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সংক্রমণের ক্ষেত্রে) রোগীর জন্য নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক কোর্সের পরামর্শ দেন। এতে আক্রান্ত ব্যাকটেরিয়া মারা যায় বা তাদের বংশ বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো, অনেক রোগী কিছু অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে আরাম বোধ করলে কোর্স শেষ না করে ওষুধ বন্ধ করে দেন।

ফলে, শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরি হয়। এর মানে, নির্দিষ্ট কোর্স ব্যতীত অল্প কয়েকদিনের ব্যবহারের পর রোগী ভালো হলেও আক্রান্ত ব্যাকটেরিয়া পুরোপুরি ধ্বংস হয় না। কিছু ব্যাকটেরিয়া আংশিকভাবে বেঁচে থেকে এন্টিবায়োটিকের শক্তি চিনে রাখে। এভাবে আস্তে আস্তে ব্যাকটেরিয়া শরীরে অভিযোজিত হয় এবং ভবিষ্যতে একই ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পরে অন্য জীবাণুর সঙ্গে মিশে এটি নতুন সংক্রমণ ঘটায়, আর পূর্বের অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকর থাকে না।

অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স শুধু আক্রান্ত ব্যক্তির জন্যই বিপজ্জনক নয়, এটি সংক্রমণের মাধ্যমে অন্যদের মধ্যেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। চিকিৎসাবিদদের মতে, বাংলাদেশের বাজারে থাকা অ্যান্টিবায়োটিকের ৫০-৭০% মানুষ ও পশুর শরীরে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেছে। এটি আমাদের জন্য এক ভয়াবহ সংকেত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ) এবং গবেষকরা বারবার সতর্ক করেছেন যে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধ এখন শুধু স্থানীয় নয়, বরং একটি আন্তর্জাতিক জনস্বাস্থ্য সংকট। প্রতি বছর লাখ লাখ মানুষ এমন সংক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছেন, এবং বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, ২০৫০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা আজকের তুলনায় অনেকগুণ বৃদ্ধি পেতে পারে।

২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রায় ১.২৭ মিলিয়ন মৃত্যুর সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। সেই সঙ্গে, গভীর বৈশ্বিক বিশ্লেষণ দেখিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে এটি প্রায় ৩ কোটি ৯০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবনসংকট সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে পরিস্থিতি এমন যে, প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকও অনেক সময় কাক্সিক্ষত ফল দিচ্ছে না, যা সাধারণ সংক্রমণকেও মারাত্মক রূপ দিতে সক্ষম।

এটি শুধু ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়, বরং সমগ্র সমাজের জন্য একটি দীর্ঘমেয়াদি হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। আজ আমরা নিজেদের ডাক্তার ভাবছি! ফার্মেসি থেকে ইচ্ছে মতো ওষুধ কিনে ব্যবহার করছি, অথবা চিকিৎসকের দেওয়া কোর্স শেষ না করে ওষুধ বন্ধ করছি। সাধারণ ভাইরাসজনিত জ্বর, সর্দি-কাশিতে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করছি, অথচ ভাইরাসজনিত রোগে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো প্রয়োজনই নেই। একটি বিষয় মনে রাখা জরুরি- সকল রোগের জন্য একই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয় না। চিকিৎসক রোগভেদে ভিন্ন ভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার এবং কোর্স অনুযায়ী সেবনের পরামর্শ দেন।

কোর্স অনুযায়ী ব্যবহার না করলে বা মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে বিপদ ঘটে- যেমন অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন, রক্তচাপ কমে যাওয়া, শারীরিক দুর্বলতা, ডায়রিয়া, পেটব্যথা, পেশির খিঁচুনি ইত্যাদি। তাই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা উচিত নয়। কোর্স শেষ না করে মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করলে ভবিষ্যতে এমন এক সময় আসবে, যখন প্রাণরক্ষাকারী অ্যান্টিবায়োটিক থাকলেও কার্যকর থাকবে না। তখন আমরা ফিরে যাব অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের পূর্বের যুগে, যেখানে সামান্য জীবাণুর কারণে মানুষের মৃত্যু হতো।

পেনিসিলিন জাতীয় ওষুধ সেই সময় আলোর দিশা দেখিয়েছিল, কিন্তু অযাচিত ব্যবহারে আজ তা অনেকটাই অকার্যকর। সিপ্রোফ্লক্সাসিলিন জাতীয় ওষুধও অনেকটাই কার্যকরী নয়। যদি এভাবে সব অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়, তাহলে সাধারণ রোগেই প্রাণহানি ঘটবে, মানবসভ্যতা ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। করোনার মহামারির উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কত দ্রুত ধরাশায়ী হয়েছিল বিশ্ব। সুতরাং, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করুন। যে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়েছেন, সুস্থ হলেও কোর্স সম্পূর্ণ করুন। এভাবে আপনি নিজেকে ও মানবকূলকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন।