১৯৯৬ ও ১৯৯৭ সালে তৎকালীন বিশ্ব দাবা চ্যাম্পিয়ন গ্যারি কাসপারভকে হারিয়ে দিয়েছিল আইবিএম এর তৈরি কম্পিউটার ‘ডিপ ব্লু’। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) এর ইতিহাসে এটি ছিল এক স্মরণীয় মুহূর্ত। কিন্তু বিগত কয়েক দশকে যতগুলো এআই বিপ্লব এসেছে, তার কোনোটিই আজকের মতো বিনিয়োগকারী ও প্রযুক্তি জগতের নেতাদের মনোযোগ কাড়তে পারেনি।
বর্তমান এআই বিনিয়োগ জোয়ারের সূচনা হয় ‘ওপেন এআই’ এর তৈরি ‘চ্যাটজিপিটি’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এটি সরাসরি ব্যবহারকারীর জন্য তৈরি করা একটি অ্যাপ, যা শক্তিশালী জিপিটিএলএম ভাষা মডেলের ওপর ভিত্তি করে কাজ করে।
সমালোচকরা যদিও এই ধরনের এআই প্রযুক্তিকে ‘স্টোকাস্টিক প্যারট’ বা ‘পরিসংখ্যানিক তোতা পাখি’ বলে আখ্যা দেন; যারা শুধু সম্ভাব্য শব্দ ও বাক্য সাজিয়ে দেয়। তবুও এআই প্রেমীরা একে ‘আর্টিফিশিয়াল জেনারেল ইনটেলিজেন্স (এজিআই)’ এর দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রথম বড় ধাপ হিসেবে দেখছেন। এই প্রযুক্তিকে আরও এগিয়ে নিতে বড় বড় কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা বিলিয়ন ডলার ঢালতে পিছপা হচ্ছেন না। ফলে বিশ্বের ব্র্যান্ড ভ্যালু বা বাজার দরের হিসেবে শীর্ষ মূল্যায়িত স্টার্টআপের তালিকায় স্থান করে নিচ্ছে এআই ইউনিকর্নগুলো। পুঁজিবাজারে নিবন্ধিত নয় এমন কোন স্টার্টআপের বাজারমূল্য বা ভ্যালুয়েশন ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলে, সেটিকে ইউনিকর্ন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয় স্টার্টআপ জগতে।
সিবিএস ইনসাইটের সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত ওপেনএআই এর বাজারমূল্য দাঁড়িয়েছে ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এককভাবে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে উচ্চ মূল্যায়িত এআই ইউনিকর্ন এটি। মাইক্রোসফটসহ বিভিন্ন অংশীদারিত্ব ও বিনিয়োগের মাধ্যমে তারা ইতোমধ্যেই প্রায় ৬৪ বিলিয়ন ডলার মূলধন সংগ্রহ করেছে। ওপেনএআই এর পরেই রয়েছে ডেটাব্রিকস, একটি বিগ ডেটা অ্যানালাইসিস প্ল্যাটফর্ম, যাদের মূল্যায়ন এখন ৬২ বিলিয়ন ডলার। এর ঠিক পরেই রয়েছে ওপেনএআই এর প্রতিদ্বন্দ্বী অ্যানথ্রপিক, যারা তৈরি করেছে ‘ক্লড’ নামের চ্যাটবট। তাদের বাজারমূল্য ৬১.৫ বিলিয়ন ডলার, আর মোট বিনিয়োগ প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি।
এছাড়া, ইলন মাস্কের নতুন উদ্যোগ ‘এক্স এআই’ কেও এই তালিকায় শীর্ষ দশে দেখা গেছে, যার ফলে বিশ্বের শীর্ষ ১০ স্টার্টআপের মধ্যে চারটিই এখন এআই খাতে। আরও একটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, তালিকার শীর্ষ আট এআই কোম্পানির মধ্যে সাতটিই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক। একমাত্র ব্যতিক্রম জার্মানির সেলোনিস, যা ২০১১ সালে মিউনিখে প্রতিষ্ঠিত হলেও বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে বেশ সক্রিয়। সেলোনিস মূলত ‘প্রসেস মাইনিং’ প্রযুক্তিতে কাজ করে, যেখানে এআই ও ডেটা টুল ব্যবহার করে ব্যবসায়িক কার্যক্রমকে আরও দক্ষভাবে সাজানো হয়।
প্রতিষ্ঠানটির বাজার মূল্য এখন ১৩ বিলিয়ন ডলার, যা এসেছে মাত্র ২.৪ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ থেকে। তালিকায় বিশেষ নজর কাড়ে ‘সেফ সুপার ইন্টেলিজেন্স’ নামের এক মার্কিন প্রতিষ্ঠান। মাত্র এক বছর আগে যাত্রা শুরু করেও এর বাজারমূল্য এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার, অথচ তারা এখন পর্যন্ত মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তুলেছেন ওপেন এআই এবং অ্যাপলের প্রাক্তন কর্মী এবং খ্যাতনামা এআই গবেষকরা। তাদের লক্ষ্য একটাই - একটি নিরাপদ এবং নিয়ন্ত্রণযোগ্য সুপারইন্টেলিজেন্ট এআই তৈরি করা, যা ভবিষ্যতে মানবজাতির জন্য সম্ভাব্য ঝুঁকি হ্রাস করবে।
তালিকায় স্টার্টআপগুলোর অবস্থান যেমনই হোক, একটা বিষয় পরিষ্কার যে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রযুক্তি বাজারের চেহারা পাল্টে দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক স্টার্টআপগুলো। এধরনের স্টার্টআপকে ঘিরে একদিকে রয়েছে বিশাল বিনিয়োগের প্রত্যাশা, অন্যদিকে নিরাপত্তা ও নৈতিকতার বড় প্রশ্ন। কিন্তু বাস্তবতা এটাই যে, এআই ইউনিকর্নগুলো এখন আর শুধুই ভবিষ্যতের গল্প নয়, বরং তারা এখন বিনিয়োগ, প্রযুক্তি ও ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করছে।