ইরান-ইসরায়েলের হামলা-পাল্টা হামলায় মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার পারদ চরমে। এমন পরিস্থিতিতে ইরানের ফরদো পারমাণবিক স্থাপনায় ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা দিয়ে হামলা চালানোর কথা ভাবছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন প্রেসিডেন্টের এমন ভাবনার পর ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি নানা প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।
যুদ্ধের ইতিহাসে অস্ত্রের বিবর্তন এক বিস্ময়কর অধ্যায়। যুগে যুগে প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা যত কঠিন হয়েছে, আক্রমণকারী শক্তির অস্ত্রশস্ত্র তত উন্নত হয়েছে। আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এমনই এক মারাত্মক অস্ত্রের নাম বাঙ্কার বাস্টার বোমা। মাটির গভীরে, পাহাড়ের গায়ে বা কংক্রিটের শক্ত প্রাচীরের পেছনে থাকা লক্ষ্যবস্তুকে ভেদ করে ধ্বংস করার অনন্য ক্ষমতা রাখে এই বোমা।
কি এই বাঙ্কার বাস্টার বোমা?
বাঙ্কার বাস্টার একধরনের বিশেষ ডিজাইন করা বোমা, যা সাধারণ মাটি বা শক্ত কংক্রিটের স্তর ভেদ করে লক্ষ্যবস্তুর গভীরে প্রবেশ করতে সক্ষম। ভেতরে গিয়ে নির্দিষ্ট গভীরতায় বিস্ফোরিত হয়ে প্রবল ধ্বংসাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
উৎপত্তি ও ইতিহাস
১৯৯১ সালের উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় এই ধরনের বোমার ব্যাপক প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। ইরাকের তখনকার শাসক সাদ্দাম হোসেন তার বহু সেনাঘাঁটি ও অস্ত্রাগার মাটির নিচে তৈরি করেছিলেন। সেগুলো সাধারণ বোমা দিয়ে ধ্বংস করা যাচ্ছিল না। তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্রুত বাঙ্কার বাস্টার জাতীয় বোমার বিকাশ ঘটায়।
প্রথম প্রজন্মের বাঙ্কার বাস্টার ছিল জিবিইউ-২৮। এরপর আরও শক্তিশালী মডেল তৈরি হয়েছে- যেমন জিবিইউ-৫৭এ/বি, যার ওজন প্রায় ৩০,০০০ পাউন্ড।
কিভাবে কাজ করে?
ডিজাইন: বাঙ্কার বাস্টার বোমার আবরণ অত্যন্ত শক্তিশালী। যা সাধারণ স্টিলের চেয়ে বেশি দৃঢ় ধাতু দিয়ে তৈরি হয়। যাতে প্রবেশের সময় ছিন্নভিন্ন না হয়ে যায়।
গতি ও ভর: বিমান থেকে উচ্চ গতিতে নিক্ষিপ্ত হয়ে এটি প্রচণ্ড গতি এবং ভরের কারণে মাটি বা কংক্রিটের স্তর ভেদ করে।
দীর্ঘ অনুপ্রবেশ: লক্ষ্যমাত্রার গভীরতায় পৌঁছানোর পর টাইমার বা সেন্সর-নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ ঘটে।
ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা: বিস্ফোরণের ফলে ভূগর্ভস্থ বা প্রতিরক্ষিত কাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধসে পড়ে।
কোথায় ব্যবহৃত হয়?
বাঙ্কার বাস্টার বোমার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য আন্ডারগ্রাউন্ড পারমাণবিক গবেষণাগার, কমান্ড সেন্টার, মিসাইল সাইলো, বাঙ্কার বা ফোর্টিফায়েড সামরিক ঘাঁটি, গোপন টানেল ও অস্ত্রভাণ্ডার।
বিশ্বের কোন কোন দেশের কাছে রয়েছে এই বোমা?
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল, রাশিয়া, চীনসহ বেশ কয়েকটি সামরিক শক্তিধর দেশের কাছে উন্নত মানের বাঙ্কার বাস্টার বোমা রয়েছে। বিশেষ করে ইরানের আন্ডারগ্রাউন্ড পারমাণবিক স্থাপনা লক্ষ্য করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের বাঙ্কার বাস্টার বহনকারী বিমান মহড়া দেয়ার ঘটনাও আন্তর্জাতিক কূটনীতিতে আলোচিত।
ব্যাংকার বাস্টারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ মডেল:
আধুনিক যুদ্ধের ভূমিকা
বর্তমান বিশ্বে বদলাচ্ছে যুদ্ধের ধরন। মাটির উপরের কাঠামো থেকে নিরাপত্তার জন্য বহু সামরিক স্থাপনা গভীর মাটির নিচে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তাই বাঙ্কার বাস্টার বোমার কৌশলগত প্রয়োজনীয়তাও বেড়ে গেছে। ‘স্টিল-পেনিট্রেটিং বম্ব’ নামেও পরিচিত এই অস্ত্র শুধু প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ধ্বংসের জন্য নয়, মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরির জন্যও ব্যবহৃত হয়।
সমালোচনা ও মানবাধিকার প্রশ্ন
কিছু মানবাধিকার সংগঠন মনে করে, বাঙ্কার বাস্টার বোমার ব্যবহারে বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ও অসামরিক মানুষের ক্ষতি হতে পারে। কারণ বিস্ফোরণের ফলে ভূগর্ভস্থ পানি, মাটির স্তর এবং আশপাশের পরিবেশে গুরুতর ক্ষতি হয়।
বাঙ্কার বাস্টার বোমা আধুনিক যুদ্ধের এক প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতার প্রতীক। এটি যেমন প্রতিপক্ষের কৌশলগত সুবিধা নস্যাৎ করার সক্ষমতা রাখে, তেমনি যুদ্ধের নীতিগত ও মানবিক প্রশ্নও সামনে তুলে আনে। ভবিষ্যতের যুদ্ধ-পরিস্থিতিতে এই বোমার ব্যবহার কী মাত্রায় পৌঁছাবে, সেটাই দেখার বিষয়।
আপনার মতামত লিখুন :