ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২৯ মে, ২০২৫

‘কিলিং মিশনে’ সন্ত্রাসী মেহেদী গ্রুপ 

মেহেদী হাসান খাজা
প্রকাশিত: মে ২৮, ২০২৫, ০৭:১০ এএম
ছবি-রূপালী বাংলাদেশ

রাজধানীর বাড্ডায় জনসমক্ষে গুলশান থানা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক কামরুল আহসান সাধনের ‘কিলিং মিশনে’ অংশ নেওয়া চারজনের মধ্যে ভিডিও দেখে দুজন শুটার শনাক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কেউ আটক হয়নি। তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সাধন হত্যার আসামিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।

অনেকেই অনেক কিছু বলছে, কিন্তু পুলিশ এখন পর্যন্ত কোনো ‘ক্লু’ উদ্্ঘাটন করতে পারেনি।  
গুলশান বিভাগের গোয়েন্দা পুলিশের একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানিয়েছেন, এ ঘটনায় আশপাশের  ভিডিও দেখে সন্দেহজনক হিসেবে দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।  তবে তাদের কাছ থেকে তেমন কিছু জানা যায়নি।

পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, সাধনকে গুলি করেছে বাড্ডার সন্ত্রাসী গোষ্ঠী মেহেদী গ্রুপের অনুসারীরা। মেহেদী আওয়ামী লীগের লোক। বিগত সরকার ক্ষমতায় থাকাকালীন মেহেদী  বিএনপি নেতা সাধনকে ব্যবসা-বাণিজ্য ও রাজনীতিতে নানাভাবে ‘প্রটেকশন’ দিতেন।

কিন্তু গত ৫ আগস্টের পর মেহেদী গ্রুপের কাউকে সাধন তেমন প্রটেকশন বা দাম দিতেন না। এ কারণে ক্ষিপ্ত হয় মেহেদীর অনুসারীরা এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবারও সাধনকে একবার হত্যার মিশনে নামে মেহেদী গ্রুপের সন্ত্রাসীরা।

এদিকে গোয়েন্দা ও থানা পুলিশের প্রাথমিক তদন্তের সূত্রমতে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মার্কেটে দোকান বরাদ্দ, বাড্ডা এলাকায় ক্যাবল টিভি সংযোগ, ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসা ও চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় দুটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

পুলিশের তথ্যমতে, এর আগে গত ২১ মার্চ গুলশানে পুলিশ প্লাজার সামনে সুমন মিয়া নামের এক ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসায়ীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ওই হত্যার প্রতিশোধ নিতেই সাধনকে হত্যা করা হয়েছে বলে ওই তদন্ত সূত্রে দাবি। তবে প্রাথমিকভাবে পুলিশ বলছে, কিলিং মিশনে সরাসরি চারজনের অংশ নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেলেও সাধনকে গুলি করে দুজন। বাকি দুজন অদূরে অবস্থান করছিল। এই চারজন ছাড়াও ঘটনাস্থল ও আশপাশে তাদের আর কোনো সহযোগী ছিল কি না, সেটিরও তদন্ত করা হচ্ছে।

স্থানীয় একাধিক সাধারণ মানুষ ও নেতারা বলছেন, গুলশান, বনানী ও বাড্ডা হলো সন্ত্রাসকবলিত এলাকা। চাঁদাবাজি ও আধিপত্য নিয়ে মাঝেমধ্যেই লাশ পড়ছে সেখানে। এ ছাড়া ‘আন্ডারওয়ার্ল্ডের’ দুটি গ্রুপের বিরোধ চলছে অনেক বছর ধরে। একদিকে ডালিম-রবিন-মাহাবুব গ্রুপ, অন্যদিকে মেহেদী হাসান কলিংস গ্রুপ। তবে গুলশানে মেহেদীর প্রভাব বেশি। মেহেদী যুক্তরাষ্ট্র থেকে এবং তার প্রতিপক্ষ গ্রুপ মালয়েশিয়া থেকে বাড্ডা এলাকার অপরাধ জগৎ নিয়ন্ত্রণ করছে।

সূত্র জানায়, ডালিম-রবিন-মাহবুব গ্রুপের সঙ্গে নিহত সাধনের ঘনিষ্ঠতা ছিল। মধ্য বাড্ডা এলাকায় বিএনপি নেতা যে ইন্টারনেট ব্যবসা করতেন, তার পেছনের শক্তি হিসেবে ছিল রবিন গ্রুপ। এই গ্রুপের সঙ্গে মেহেদী গ্রুপের বিরোধ দীর্ঘদিনের। মেহেদীরও কাছের লোক ছিলেন বিএনপির নেতা সাধন। তা ছাড়া হত্যাকাণ্ডের পেছনে আধিপত্য ও রাজনৈতিক প্রভাবও আছে। সব মিলিয়ে এসব দ্বন্দ্বে খুন হন সাধন।

সাধন খুনের পর ঘটনাস্থলে গিয়ে জানা যায়, সাধনের সঙ্গে বসে ছিলেন তাঁর তিন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ব্যাবসায়িক অংশীদার। তারা হলেন কামরুল ইসলাম, আবুল হোসেন ও জাকির হোসেন রূপক।

সাধনের বন্ধুরা জানান, সাধনসহ আমরা যারা বসে ছিলাম, সবাই বাল্যবন্ধু। কিছুদিন আগে আমরা চারজনসহ ১০ জন মিলে ডেভেলপার কোম্পানি খুলেছি। তবে এখনো কার্যক্রম শুরু হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। প্রায় প্রতি রাতেই আমরা ৪ নম্বর সড়কে বসে আড্ডা দিই। রোববার রাতে বসার আনুমানিক পাঁচ-ছয় মিনিট পরই দুজন এসে হঠাৎ সাধনকে গুলি করে। গুলি ছুড়তে ছুড়তে পালিয়ে যায় তারা।

ঘটনাস্থলের পাশের মুদি দোকানি মো. হানিফ জানান, ঘটনার সময় সেখানে তিন-চারজন ক্রেতা ছিল। হঠাৎ শব্দ শুনতে পান তিনি। এ সময় অস্ত্র হাতে দুজনকে তার দোকানের সামনে দিয়ে পালাতে দেখেন।

বাড্ডা থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, নিহত সাধন বুকে, পিঠে ও গলায় গুলিবিদ্ধ হন। অজ্ঞাতনামা মামলায় কোনো আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। যে দুজন গুলি চালিয়েছে, তাদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। অবিলম্বে গ্রেপ্তারে অভিযান চলছে। তবে এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তেমন কোনো ক্লু পাওয়া যায়নি। অনেকেই অনেক কিছু লিখছেন, তবে গুরুত্বপূর্ণ তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

সাধনের স্ত্রীর বড় ভাই সাখাওয়াত হোসেন সরকার জানান, রোববার সকাল ১০টায় বাসা থেকে বের হন সাধন। দুপুরে বাসায় খেতে যাওয়ার কথা থাকলেও যাননি। তবে খুন হওয়ার আগে তিনি কানা মিলনের দোকানে গিয়েছিলেন।

নিহতের স্ত্রী দিলরুবা আক্তার জানান, সাধনকে ফোন করে বাসায় আসতে বললে তিনি বলেন আসতে পারবেন না। পরে বিকেলে তাদের এক আত্মীয় বাসায় আসেন এবং সাধনের সঙ্গে দেখা করার কথা বলেন। এ সময় দিলরুবা তার স্বামীকে ফোন করে বাসায় আসতে বলেন। রাত পৌনে ১০টায় সাধন যখন বাসায় প্রবেশ করেন, তখন তার স্ত্রী নামাজ আদায় করছিলেন।

নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন স্বামীকে। তখন সাধনের ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ফোন রিসিভ করলে অপর প্রান্ত থেকে একজন বাসার অদূরে কানা মিলনের দোকানের কাছে যেতে বলেন। এর পরই তিনি বাসা থেকে বের হয়ে যান। বাসা থেকে যাওয়ার ২০-২৫ মিনিট পর গুলির ঘটনা জানতে পারেন দিলরুবা।

সূত্র জানায়, ২০১৮ সাল থেকে মধ্য বাড্ডা এলাকায় প্রথমে ডিশ ও পরে ইন্টারনেটের ব্যবসা শুরু করেন সাধন। এ ছাড়া মাস দুয়েক আগে বন্ধুদের সঙ্গে ডেভেলপার ব্যবসা খোলেন। এর আগে ২০০৫ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত গুলশান-১ নম্বরে রেস্টুরেন্টের ব্যবসা করেছেন তিনি। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গুলশান সিটি করপোরেশন মার্কেটে একটি দোকানঘর বরাদ্দ পান তিনি। সেখানেই ব্যবসা করছিলেন তিনি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) এস এন মো. নজরুল ইসলাম জানান, পুলিশ প্লাজার সামনে গুলি করে একজন ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়েছিল। একইভাবে সাধনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, ওই হত্যার প্রতিশোধ নিতে হয়তো বিএনপি নেতা সাধনকে হত্যা করা হয়। তবে তদন্ত শেষে না হওয়া পর্যন্ত এই হত্যার আসল কারণ বের করা কঠিন।

প্রসঙ্গত, পুলিশ সদর দপ্তরের অপরাধ পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী, গত চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) শুধু রাজধানীতেই ১৩৬টি খুনের ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ৩৮টি খুন হয়েছে ফেব্রুয়ারি মাসে।