ঢাকার জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে হাসপাতালের কর্মচারীদের সংঘর্ষের জেরে সেখানে গতকাল শনিবারও সেবা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বর্তমানে হাসপাতালটিতে জুলাইয়ে আহত ছাড়া অন্য কোনো রোগী ভর্তি নেই। সবাই আতঙ্কে হাসপাতাল ছেড়েছেন। এমনকি চিকিৎসক-নার্সরাও আতঙ্কে হাসপাতালে আসছেন না। ফলে গত চার দিন ধরে বন্ধ রয়েছে হাসপাতালটির সব ধরনের চিকিৎসাসেবা।
চক্ষু চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ এ হাসপাতালটি প্রায় অচল থাকায় দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা চিকিৎসা না নিয়েই ফিরে যাচ্ছেন। যা মানুষের মৌলিক চাহিদার অন্তরায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সরকারকে এ ব্যাপারে কার্যকরি উদ্যোগ নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
জানা যায়, হাসপাতালটির কর্মচারীরা গত বুধবার সকাল থেকে কর্মবিরতি শুরু করলে সকাল ১০টার পর তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায় সেখানে চিকিৎসাধীন জুলাই আন্দোলনে আহতরা। একপর্যায়ে সেদিন আহতদের সঙ্গে যোগ দেন বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা। পরে দুপুরের দিকে সেনা সদস্যরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করেন। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে বিকেলের দিকে। চিকিৎসক ও কর্মচারীদের ওপর হামলার অভিযোগ এনে নিরাপত্তার দাবিতে সেদিন থেকেই হাসপাতালে আসা বন্ধ রেখেছেন চিকিৎসক ও কর্মচারীরা।
ওইদিন জুলাইয়ের আহতরা হাসপাতালের চিকিৎসক-কর্মচারীদের আবাসিক ভবনেও হামলা চালায় বলে অভিযোগ করেছিলেন হাসপাতালের এক চিকিৎসক। এই ঘটনায় চিকিৎসক ও কর্মচারীদের অনেকেই আহত হয়েছেন বলেও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক চিকিৎসক জানে আলম জানিয়েছিলেন। এর ধারাবাহিকতায় শনিবারও বন্ধ রয়েছে হাসপাতালটিতে সব ধরনের সেবা কার্যক্রম। এদিন সকালে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, বিভিন্ন এলাকা থেকে রোগীরা আসছেন। কিন্তু ফটক বন্ধ থাকায় ভেতরে যেতে পারছেন না তারা। বাইরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে চলে যাচ্ছেন।
রাজধানীর কাওলা থেকে আসা রোগী ইসমত আরা বলেন, আমার বাবাকে নিয়ে এর আগে গত শনিবার আসছিলাম। ডাক্তাররা বাবাকে দেখে কিছু পরীক্ষা করাতে দেয়, সেগুলোর দেখানোর জন্য শনিবার (গতকাল) ডেট দিয়েছিল। কিন্তু এসে দেখি সব বন্ধ। কোথায় যাব কি করব বুঝতে পারছি না।
সাভারের আমিনবাজার থেকে সাব্বির আহমেদ ছয় মাস বয়সি শিশুকে নিয়ে এসেছেন চোখের জটিলতা দেখাতে। কিন্তু এসে শুনেন হাসপাতালে কোনো চিকিৎসক নেই। ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এত কষ্ট করে বাচ্চাকে নিয়ে আসলাম কিন্তু চিকিৎসা বন্ধ থাকায় ইস্পাহানি ইসলামিয়া চক্ষু হাসপাতালে চলে যাচ্ছি এখন।
প্রতিদিনের মতো দায়িত্ব পালন করতে এসে ফিরে যেতে হয় হাসপাতালটির নার্স, কর্মচারী, কর্মকর্তাকেও। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নার্স বলেন, বুধবার জুলাই যোদ্ধাদের হামলায় হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সসহ অনেকে আহত হয়েছেন। এ অবস্থায় হাসপাতালে নিরাপদ বোধ করছেন না তারা। সবার সঙ্গে আমিও সেদিন অবরুদ্ধ ছিলাম, আর্মি গিয়ে উদ্ধার করেছে। পুরো হাসপাতাল তারা নিজেদের মতো করে চালাতে চায়। এদের জন্য আমরা কি না করেছি। তাদের অনেককে বিদেশ থেকে চিকিৎসা করিয়ে আনা হয়েছে। এখন তারা স্যারকে জিম্মি করেছে সবাইকে বিদেশ যাওয়ার রেফারেন্স লিখে দিতে হবে। পুরো হাসপাতালটাকে তারা জিম্মি করে রেখেছে।
এর আগে জুলাই ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আকবর কামাল গতকাল শনিবার সাংবাদিকদের বলেন, সেদিনের (বুধবার) ঘটনায় চিকিৎসক, কর্মচারীদের সঙ্গে জুলাই যোদ্ধাদের কয়েকজনও আহত হয়েছেন। দুই পক্ষের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছেন তারা। তিনি বলেন, জুলাইযোদ্ধারা হাসপাতালের আট থেকে ১০ জন কর্মচারীর একটি তালিকা দিয়েছে। তারা বলছে, ওই কয়েকজন বাদে বাকিরা হাসপাতালে এসে সেবা দিতে কোনো বাধা নেই। আমরাও তাদের বোঝানোর চেষ্টা করছি যে, হাসপাতালটি বন্ধ থাকায় মানুষের ভোগান্তি হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গেও নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। একটা ভালো সমাধান হবে আশা করি।
উন্নত চিকিৎসা বা পুনর্বাসনের বিষয়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার অভিযোগ তুলে গত রোববার চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালে চিকিৎসাধীন চার জুলাইযোদ্ধা বিষপান করেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় তারা সহযোদ্ধাদের নিয়ে মঙ্গলবার দুপুরে চক্ষুবিজ্ঞান হাসপাতালের পরিচালককে অবরুদ্ধ করেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা বাদে সেনাবাহিনীর সহায়তায় অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি পান হাসপাতাল পরিচালক। এর মধ্যে আন্দোলনকারীদের কেউ কেউ গায়ে কেরোসিন-পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে পুলিশের ভাষ্য।
পরিচালককে অবরুদ্ধ রাখা এবং আহতদের আত্মহত্যার চেষ্টার ঘটনায় নিরাপত্তার দাবিতে গত বুধবার সকাল থেকে কর্মবিরতি পালন করছিলেন হাসপাতাল কর্মচারীরা। এ অবস্থায় হাসপাতালের কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান জুলাই আন্দোলনে আহতরা। পরে আহতদের সঙ্গে যোগ দেন বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা রোগীর স্বজনরা।
এসব বিষয় নিয়ে গতকাল শনিবার এক বিবৃতি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় বলে, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসকসহ অন্যান্য সেবাদানকারীরা গত ২৯ মে তারিখে হাসপাতাল অভ্যন্তরে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনায় বর্তমানে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন।
উল্লেখ্য, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই এই হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ সর্বোচ্চ চিকিৎসাসেবা প্রদান করে আসছেন।
দুর্ভাগ্যজনক এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সব সেবাদানকারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন বিধায় গত বৃহস্পতিবার থেকে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। এ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি অধিকাংশ রোগী হাসপাতাল ত্যাগ করেন। বর্তমানে কেবল জুলাই যোদ্ধাগণই হাসপাতালে অবস্থান করছেন। সব সেবা বন্ধ থাকলেও জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের লক্ষ্যে বিশেষ ব্যবস্থায় তাদের পথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে সারা দেশ থেকে আগত চক্ষু রোগীদের চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আমরা সেবাবঞ্চিত সব রোগীর প্রতি আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।
এই অচলাবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হয়েছে। প্রতিনিধিদল আহতদের সঙ্গে এবং বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকসহ অন্যান্য সেবাদানকারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা করছেন। এই মুহূর্তে আমরা আলোচনার একটি ইতিবাচক ফলের প্রত্যাশায় আছি।
চিকিৎসাসেবার অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত হলেই ওই হাসপাতালের সব ধরনের চিকিৎসাসেবা পুনরায় চালু করার সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই সময়ে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে চক্ষু চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে এমন রোগীদের নিকটস্থ হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে চিকিৎসাসেবা গ্রহণের জন্য অনুরোধ করা যাচ্ছে।