শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর চলতি বছরের গত জুন মাস পর্যন্ত দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ৭৬৮টি দুর্নীতির অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করেছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে গত ১১ মাসে সংস্থাটি তৎকালীন সরকারের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে ৩৯৯টি মামলা দায়ের করে। যাতে আসামি করা হয়েছে ১ হাজার ২৬৪ জনকে। একই সময়ে ৩২১টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করেছে দুদক। এতে ১ হাজার ৩৫৬ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
দুর্নীতির এসব অভিযোগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সংসদ সদস্য (এমপি), সিনিয়র সচিব ও সচিবসহ বিভিন্ন পর্যায়ের প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে। একসময় যাদের ইশারায় চলত দুদক। সেসব প্রভাবশালীই এখন সংস্থাটির জালে। দুদক এখন দেশের সেসব রাঘববোয়ালদের দুর্নীতিবাজদের ধরতে ব্যস্ত সময় পার করছে।
ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপরই অনেক মন্ত্রী-এমপি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। অনেকে আবার দেশে আত্মগোপনে চলে যান। এরপর দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরই নড়েচড়ে বসে দুদক। ১৫ বছরে যেসব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও অধিদপ্তরে দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে সেগুলোর অনুসন্ধান জোরেশোরে চালাচ্ছে সংস্থাটি। ইতিমধ্যে আওয়ামী সরকারের বেশ কিছু প্রভাবশালীকে গ্রেপ্তার করেছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সদস্যরা।
দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) মো. আকতারুল ইসলাম বলেন, দেশের দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে কাজ করছে দুদক। দুদকের গত ১১ মাসের কার্যক্রম পর্যালোচনা করলেই দেখা যাবে কমিশন কী করছে, কাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে।
তিনি বলেন, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ১১ মাসে ১২ হাজার ৮২৭টি দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে দুদক। এর মধ্যে আগস্টে ৮৪৭টি, সেপ্টেম্বরে ৮৯৮টি, অক্টোবরে ১৬৮৭টি, অক্টোবরে ৩৪০৬টি, ডিসেম্বরে ৬৬টি, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৩৫০টি, ফেব্রুয়ারিতে ৫৫১টি, মার্চে ৯৫১টি, এপ্রিলে ৮০৩টি, মে মাসে ১৯৩৪টি এবং জুন মাসে ১৩৩৪টি। বর্তমানে সংস্থাটিতে ৩ হাজার ৫০০ অভিযোগের অনুসন্ধান চলমান রয়েছে।
দুদকের তথ্য বলছে, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত ১১ মাসে ৭৬৮টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয় এবং অনুসন্ধান শেষে ৩৯৯টি মামলা করা হয়েছে। মামলায় ১ হাজার ২৬৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া একই সময়ে ৩২১টি মামলার তদন্ত শেষ করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। চার্জশিটে ১ হাজার ৩৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
দুদকের তথ্য মতে, গত বছরের ৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত সময়ে ৩৯৯টি মামলায় মোট ১ হাজার ২৬৪ জনকে আসামি রয়েছেন। এর মধ্যে সরকারি চাকরিজীবী ৩৪৩ জন, বেসরকারি চাকরিজীবী ৪৪৭ জন, ব্যবসায়ী ১১৪ জন, রাজনীতিবিদ ৯২ জন, জনপ্রতিনিধি ৩১ জন এবং অন্যান্য ২৩৭ জন। একই সময়ে ৩২১টি মামলার তদন্ত শেষ করে বিচারিক আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে। চার্জশিটে ১ হাজার ৩৫৬ জনকে আসামি করা হয়েছে।
যেসব প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে: দুদকের তথ্য মতে, গত ৫ আগস্টের পর দুদক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা ও তাদের ছেলে-মেয়েসহ অন্যদের বিরুদ্ধে রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট জালিয়াতির অভিযোগে মামলা করে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, পাবলিক সার্ভেন্ট হয়ে অপরাধমূলক অসদাচরণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে আইন অনুয়ায়ী বরাদ্দ পাওয়ার যোগ্য না হওয়া সত্ত্বেও পরস্পর যোগসাজশ করে নিজেরা লাভবান হয়ে অন্যকে লাভবান করার উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসিক প্রকল্পের ২৭ নম্বর কূটনৈতিক সেক্টরের ২০৩ নম্বর রোডের ১০ কাঠা আয়তনের ৬টি প্লট বরাদ্দ নেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানা এবং তাদের ছেলে-মেয়েদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা দায়ের করা হয়।
মামলার তদন্ত শেষে চলতি বছরের ১০ মার্চ ২৭ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিলের অনুমোদন দেয় কমিশন। ইতিমধ্যে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
দুদকের তথ্য বলছে, গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের তথ্য গোপনসহ ৮৫ কোটি ৩২ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তার স্ত্রী ও দুই সন্তানের নামে তিনটি মামলা দায়ের করা হয়।
একই মাসে সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু ও পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে ৬৪ কোটি ১৮ লাখ ৯৯ হাজার ৫৮৯ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩২২১ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন; সাবেক বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম ও স্ত্রী দেওয়ান আলেয়ার স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানির নামে ৬০টি ব্যাংক হিসাবে ৭২৫ কোটি ৭০ লাখ ৪২ হাজার ২৩২ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন এবং ৬৭ কোটি ৫৪ লাখ ২২ হাজার ২৫২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা করে।
জানুয়ারি মাস
দুদকের তথ্য মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ৯৬টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। একই সময়ে ৭০ মামলা দায়ের এবং ২৮টি মামলার চার্জশিট আদালতে দাখিল করা হয়। এর উল্লেখযোগ্য মামলা হলো- ১৪৬ কোটি ১৯ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ২৯টি ব্যাংকে ৬৬৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকার বেশি সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে সাবেক আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
একই মাসে সাবেক রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম ও তার স্ত্রী-সন্তানের বিরুদ্ধে ২৬টি ব্যাংক হিসাবে মোট ৩১৪ কোটি ৫৬ লাখ ২৬ হাজার ৩৭৪ টাকার অবৈধ লেনদেন এবং ৩১ কোটি ১৯ লাখ ৭৭ হাজার ৫৮১ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন; সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবীর বিন আনোয়ারের বিরুদ্ধে ২ কোটি ৮৪ লাখ ৪০ হাজার ৪৬ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৯টি ব্যাংক হিসাবে ১৫ কোটি ৩৮ লাখ ৫৭ হাজার ৮২৫ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন।
সাবেক প্রাথমিক ও গণ শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের ১২ কোটি ৮১ লাখ ১৪ হাজার ৩৮৯ টাকার সম্পদ অর্জন এবং ৯টি ব্যাংক হিসাবে ৩০ কোটি ৪৫ লাখ ৩২ হাজার ৮৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন; সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে ৭ কোটি ৮০ লাখ ২০ হাজার ৯৩৭ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৩৫টি ব্যাংক হিসাবে ১৩৯ কোটি ৭৪ লাখ ৯৮ হাজার ১১৭ টাকা লেনদেনের মামলা।
ফেব্রুয়ারি মাস
ফেব্রুয়ারি মাসে ৯৫টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। একই সময়ে ৫৪টি মামলা দায়ের এবং ৫২টি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়।
এর উল্লেখ্য মামলা হলো- সাবেক সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং তার স্বামীর বিরুদ্ধে প্রায় ৮ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ব্যাংকে প্রায় ৬০ কোটি টাকার সন্দেহভাজন লেনদেন; সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ১১ কোটি ৩৬ লাখ ৫১ হাজার ৫৫৫ টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তার ৯টি ব্যাংক হিসাবে ৮৬ কোটি ৬৯ লাখ ৩২ হাজার ৭৬৯ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন।
সাবেক মন্ত্রী আব্দুর রহমানের বিরুদ্ধে ১ কোটি ৭২ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তার ১৯টি ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ৮৯১ কোটি টাকার বেশি সন্দেহজনক লেনদেন ও তার স্ত্রী ডা. মির্জা নাহিদা হোসেনের বিরুদ্ধে ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তার ১৬টি ব্যাংক হিসাবে ২৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের মামলা।
মার্চ মাস
এই মাসে ১০১টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। একই সময়ে ২৯টি মামলা দায়ের এবং ৩১টি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এর উল্লেখ্য মামলা হলো- সাবেক প্রতিমন্ত্রী ওমর ফারুক চৌধুরী ও তার নিগার সুলতানা চৌধুরীর বিরুদ্ধে ১৫ কোটি ৯০ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন ও তাদের ব্যাংক হিসাবে ৪৪৯ কোটি ৫৮ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮২ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে দুটি।
পুলিশের সাবেক ডিআইজি আব্দুল বাতেন ও তার স্ত্রী নুর জাহান আক্তার হীরার বিরুদ্ধে ৩ কোটি ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫৫২ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তাদের ১১টি ব্যাংক হিসাবে ২১ কোটি ৯৬ লাখ ৬০ হাজার ২১৩ টাকা সন্দেহজনক লেনদেনের মামলা।
এপ্রিল মাস
এই মাসে ১১৮টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। একই সময়ে ৪১টি মামলা দায়ের এবং ২১টি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এর উল্লেখ্য মামলা হলো- সাবেক প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ২৭ কোটি ৩৮ লাখ ৯৭ হাজার ৫৮৫ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ৬টি ব্যাংক হিসাবে ২৬০ কোটি ৯৪ লাখ ৯৬ হাজার ৭৩০ টাকা সন্দেহজনক লেনদেন।
রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এনামুল হকের ব্যাংক হিসাবে ২ হাজার ২৩৯ কোটি টাকা সন্দেহজনক লেনদেন এবং ১৮ কোটি ৮ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন; সাবেক মন্ত্রী আকম মোজাম্মেল হকের ১০ কোটি ৩৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪২৭ টাকার সম্পদ অর্জন এবং ৩টি ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমে ৮ কোটি ৩২ লাখ ৭৪ হাজার ১১৪ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের অপরাধে মামলা।
মে মাস
এই মাসে ৭২টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। একই সময়ে ৩০টি মামলা দায়ের এবং ১৯টি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এর উল্লেখ্য মামলা হলো- সাবেক সংসদ সদস্য মামুনুর রশীদ কিরণের ব্যাংক হিসাবে ২১১ কোটি ৫৬ লাখ ৫৩ হাজার ২৪১ টাকা সন্দেহজনক লেনদেন এবং ৪৯ কোটি ৫৪ লাখ টাকার বেশি অবৈধ সম্পদ অর্জন।
ভবনের স্পেস ক্রয়ের নামে ২ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বেশি আত্মসাতের অভিযোগে ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি ও বেঙ্গল গ্রুপের চেয়ারম্যান মোরশেদ আলমহ ৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা এবং সাবেক সংসদ সদস্য সৈয়দা রুবিনা আক্তার মীরার বিরুদ্ধে ১ কোটি ৫৭ লাখ ১৮ হাজার টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং ১০টি ব্যাংক হিসাবে ২৭৮ কোটি ৫২ লাখ ৫৬ হাজার ৬৩২ টাকা সন্দেহভাজন লেনদেনের মামলা।
জুন মাস
এই মাসে ৪৮টি অভিযোগের অনুসন্ধান শুরু করা হয়। একই সময়ে ৩১টি মামলা দায়ের এবং ২৪টি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। এর উল্লেখ্য মামলা হলো- সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে ৩৫ কোটি ১৮ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং তার ব্যাংক হিসাবে ৯৯ কোটি ২১ লাখ টাকা ও ১১ লাখ ৩৩ হাজার ডলারের বেশি সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে মামলা।