রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ (মিটফোর্ড) হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে নৃশংসভাবে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ হত্যাকা-ের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। ব্যক্তিগত ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণেই এই নির্মম হত্যাকা- ঘটেছে।
গতকাল বুধবার ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের পক্ষ থেকে এমনটাই জানানো হয়। এ সময় কমিশনার বলেন, মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সেই সঙ্গে অপরাধীদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে এবং কোনো অপরাধী যেন ছাড় না পায়, পুলিশেকে সেই নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাদ আলী বলেন, গত ৯ জুলাই বিকাল আনুমানিক ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটের সামনে পাকা রাস্তার ওপর কতিপয় দুর্বৃত্ত দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে লাল চাঁন ওরফে সোহাগ নামের এক ব্যক্তিকে প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমরা এ ঘটনায় মর্মাহত এবং নিহতের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
তিনি বলেন, ঘটনা চলাকালে ৯৯৯-এর মাধ্যমে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঘটনার সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি চকবাজার পুলিশ ফাঁড়িকে অবহিত করলে ইনচার্জ উপপরিদর্শক সরোয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। সেখানে গিয়ে পুলিশ দেখতে পায়, অভিযুক্তরা একটি মবের পরিবেশ তৈরির চেষ্টা করছে। ‘চাঁদাবাজদের জায়গা নেই, ব্যবসায়ীদের ভয় নেই’ এমন স্লোগান দিচ্ছে।
এ অবস্থায় চকবাজার পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই সরোয়ার ঘটনাস্থল থেকে মাহমুদুল হাসান মহিনকে এবং ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে রবিন নামের অপর একজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা ও ঘটনাস্থলের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আরও সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ঘটনায় মোট ৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে ভিকটিম সোহাগের ওপর পাথর নিক্ষেপকারী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা গেলেও সে সময় তার পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। পরে পুলিশের বিশেষ টিমের সহায়তায় তার পরিচয় নিশ্চিত হয়ে অবস্থান চিহ্নিত করে ১৫ জুলাই পটুয়াখালী জেলা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, তার নাম মো. রেজওয়ান উদ্দিন অভি। বাবার নাম মনোরঞ্জন বসু, মায়ের নাম বিউটি দেব মিলা। সে একজন ধর্মান্তরিত মুসলিম। এ ঘটনায় পাথর নিক্ষেপকারী দুজনসহ মোট ৯ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এই হত্যাকা-ের প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের জন্য গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, এ ঘটনার এজাহার নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে বিভ্রান্তিমূলক তথ্য ছড়ানো হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা হলো, মামলার এজাহার দায়েরের জন্য প্রথমে তার সাবেক স্ত্রী লাকি আক্তার থানায় আসেন। কিছুক্ষণের মধ্যে ভুক্তভোগীর সৎভাই রনিও থানায় আসেন। তারা নিজেদের মধ্যে সলাপরামর্শ করে ২৩ জনকে আসামি করে একটি খসড়া এজাহার প্রস্তুত করেন। এর মধ্যে ভুক্তভোগীর আপন বড় বোন মঞ্জু আরা বেগম থানায় এসে এজাহার দাখিলের আগ্রহ প্রকাশ করেন। তখন তার সামনে পূর্বের খসড়া এজাহার উপস্থাপন করা হয়। তখন বাদিনীর মেয়ে ওই খসড়া এজাহারের ছবি তুলে রাখেন, যা পরবর্তীতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভুক্তভুগীর বোন ওই খসড়া এজাহার থেকে পাঁচজনের নাম বাদ দিয়ে নতুন করে আরও একজনের নাম সংযোজন করে মোট ১৯ জনকে আসামি করে এজাহার দাখিল করেন।
এই নারকীয় হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে এবং এমন নৃশংস অপরাধের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, সে জন্য অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করা হবে বলে ডিএমপি কমিশনার দৃঢ প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
মহানগরীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষা এবং অপরাধ প্রতিরোধে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা ও পেশাদারির সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবেÑ এমনটা জানিয়ে ডিএমপি কমিশনার বলেন, কোনো অপরাধী যেন ছাড় না পায়, তাদের কঠোরভাবে দমন করতে হবে।
ইউনিট-প্রধানের প্রধান দায়িত্ব হলো নিজ ইউনিটকে দক্ষতার সঙ্গে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা মন্তব্য করে ডিএমপি কমিশনার বলেন, সবাইকে দায়িত্ববোধ ও আগ্রহের সঙ্গে পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে হবে। নিয়মিত টহল জোরদার, অপরাধপ্রবণ এলাকায় নজরদারি বাড়ানো, চেকপোস্ট পরিচালনা করা, মামলা তদন্তে অগ্রগতির পাশাপাশি মামলা নিষ্পত্তির হার বাড়াতে হবে। চোরাই গাড়ি উদ্ধার, মাদক উদ্ধার ও ওয়ারেন্ট তামিলে আরও তৎপর হতে হবে।
এ সময় অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) ফারুক আহমেদ বলেন, ওয়ারেন্ট তামিল ও মামলা তদন্তের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা করে কাজ করতে হবে। স্থানীয় সম্প্রদায়ের সঙ্গে সহযোগিতা করে জনবান্ধব পুলিশিং নিশ্চিত করতে হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমরা এই হত্যাকা-ের সঙ্গে কোনো রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা পাইনি। চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, চাঁদাবাজির কোনো বিষয় আমরা পাইনি, মূলত ব্যাবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণেই এই হত্যাকা- চালানো হয়েছে। তাদের নিজেদের মধ্যে ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে ঝামেলা চলছিল।
সোহাগ হত্যা: রবিনসহ নতুন গ্রেপ্তার আরও ২ জন রিমান্ডে : এদিকে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে নৃশংস হত্যার ঘটনায় তারেক রহমান রবিনসহ তিনজনের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মো. সাইফুজ্জামানের আদালত রিমান্ডের এই আদেশ দেন। অন্যরা হলেন রিজওয়ান উদ্দিন ওরফে অভিজিৎ বসু (৩১) ও মো. নান্নু কাজী (৩৩)। এদিন তাদের আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান তাদের ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে আবেদন করেন। শুনানি শেষে আদালত তাদের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তবে আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
প্রসঙ্গত, ভাঙ্গারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদ হত্যার ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় দুটি মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা, অপরটি অস্ত্র মামলা। গত ৯ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে হাসপাতালের ৩ নম্বর গেটসংলগ্ন রজনী ঘোষ লেনে এই হত্যার ঘটনা ঘটে।
আপনার মতামত লিখুন :