ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধে বন্ধ মানবিক সহায়তা। উপত্যকাজুড়ে হাজারো মানুষ রয়েছেন দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে। এরই মধ্যে অনাহারে প্রাণ হারিয়েছে মাত্র ৩৫ দিন বয়সি এক নবজাতক।
গত শনিবার গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালে শিশুটির মৃত্যু হয়। গতকাল রোববার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা। জাতিসংঘের হিসাব বলছে, গাজায় ক্রমবর্ধমান খাদ্যসংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে শিশুরা। মার্চ থেকে খাদ্য সরবরাহ সীমিত করায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
এখন পর্যন্ত অনাহারে প্রাণ গেছে অন্তত ৬৯ শিশুর। এদিকে, ইসরায়েলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় একই দিনে নিহত হয়েছে অন্তত ১১৬ জন ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে ৩৮ জন প্রাণ হারিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) একটি ত্রাণকেন্দ্রের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, খাদ্যসংকটে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। সেখানে অন্তত ১৭ হাজার শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। হাসপাতাল পরিচালক ডা. মুহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেন, ‘শুধু শনিবার আমাদের হাসপাতালে অনাহারে অন্তত দুজন মারা গেছে, যার মধ্যে একটি নবজাতকও রয়েছে।’ এদিকে গাজার খান ইউনিস ও রাফাহ অঞ্চলেও ইসরায়েলি হামলায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে বলে জানায় সিভিল ডিফেন্স সংস্থা।
প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন, ‘মানুষ একটু খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়ায়, কিন্তু ফিরে যায় লাশ হয়ে।’ আন্তর্জাতিক রেড ক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট ফেডারেশনের মহাসচিব জগন চাপাগাইন বলেন, ‘গাজায় ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।’ একই সুরে নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান ইয়ান এগেল্যান্ড বলেন, ‘গত ১৪২ দিনে আমরা একটি ট্রাকও গাজায় ঢোকাতে পারেনি।’
জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানিয়েছে, মিশর সীমান্তে তাদের যথেষ্ট খাদ্য মজুত থাকলেও ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞায় সেগুলো গাজায় প্রবেশ করতে পারছে না। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেÑ ‘সীমান্ত খুলুন, অবরোধ তুলে নিন এবং আমাদের কাজ করতে দিন।’
ইসরায়েলি অবরোধে অভুক্ত শিশুদের মুখে খাবার তুলে দিতে পারছেন না গাজা উপত্যকার অসহায় বাবা-মায়েরা। ভুক্তভুগীরা বলছেন, ‘শিশুদের তো কোনো দোষ নেই। তারা বিশ্বের অন্যান্য শিশুর মতোই বেড়ে উঠতে চেয়েছিল। পৃথিবীতে সুন্দর জীবনযাপন করতে চেয়েছিল।’ জাতিসংঘে রাশিয়ার স্থায়ী প্রতিনিধি ভ্যাসিলি নেবেনজিয়া বলেন, ‘ক্ষুধার্তদেরও মৃত্যুর দিকে ঢেলে দেওয়ার প্রতীক হয়ে উঠেছে ইসরায়েলি আগ্রাসন। জিএইচএফ ত্রাণকেন্দ্রে গুলি করেও হত্যা করা হচ্ছে। এ অবস্থায় আমরা মানবিক সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে বসে বসে মানবিক বিপর্যয় দেখতে পারি না।’
এমনকি অবরোধের কারণে জাতিসংঘ এবং অন্যান্য দাতব্য সংস্থা দ্বারা পরিচালিত প্রায় ৪০০ ত্রাণকেন্দ্র থাকলেও খোলা রয়েছে মাত্র চারটি পয়েন্ট, যেখানে ২৩ লাখ গাজাবাসীর চাহিদা মেটানোর মতো নেই সহায়তা সামগ্রী। এতে গাজাবাসী দুর্ভিক্ষের তীব্র ঝুঁকির মুখোমুখি বলে সতর্ক করেছেন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মহাসচিব জাগান চাপাগেইন। অবরোধ তুলে নিলে গাজাবাসীর জন্য দুই মাসের খাদ্যসহায়তা দিতে প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে ডব্লিউএফপি। ডব্লিউএফপির ডেপুটি এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর কার্ল স্কাউ বলেন, ‘আমাদের সক্ষমতা আছে। আমরা কমপক্ষে দুই মাসের খাবার পৌঁছে দিতে প্রস্তুত। যদি কোনো অগ্রগতি হয়, তার পরদিন থেকেই আমরা এটি করতে পারব।’
গাজার হাসপাতালের জরুরি বিভাগগুলোয় চরম অনাহারে মৃত্যুর মুখে চলে যাওয়া মানুষের ভিড় উপচে পড়ছে। এসব ঘটনা এমন সময়ে ঘটেছে, যখন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সতর্ক করে বলেছে, এমন অবস্থা আগে কখনো দেখা যায়নি। কর্মকর্তারা বলছেন, গাজার ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসকে চাপে ফেলতে ভূখ-টিতে ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিচ্ছে ইসরায়েল। সেখানে ত্রাণের সন্ধানে বের হওয়া মানুষের ওপরও গুলি চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল সমর্থিত একটি সংগঠনের ত্রাণ বিতরণকেন্দ্রকে ‘মৃত্যুকূপ’ বলে বর্ণনা করছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
এদিকে ফিলিস্তিনের গাজায় এক দিনে ৯০টি হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। শনিবার দখলদারদের সেনাবাহিনী নিয়মিত ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানায়। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের বিমানবাহিনী গত দিনে অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকাজুড়ে ৯০টি হামলা চালিয়েছে। মাত্র ৩৬৫ বর্গকিলোমিটার (১৪০ বর্গমাইল) আয়তনের ভূখ-ে এমন হামলা যে কোনো যুদ্ধক্ষেত্রের তুলনায় ব্যাপক। তারা দাবি করেছে, গাজার যোদ্ধাদের সামরিক কম্পাউন্ড ও ভূগর্ভস্থ অবকাঠামোতে আঘাত করা হয়েছে।
এদিকে মার্কিন প্রস্তাবিত ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি এবং মিশর-কাতারের মধ্যস্থতায় জিম্মি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষ্যে দোহায় ইসরাইল-হামাসের মধ্যে পরোক্ষ আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ইতিপূর্বে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে আগ্রাসন চালানোয় অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি আর সম্ভব নয় বলে জানিয়েছে গাজার স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস।
আপনার মতামত লিখুন :