ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ জুলাই, ২০২৫

বদলি-বরখাস্তে রাজস্ব লক্ষ্যপূরণ নিয়ে শঙ্কা

শাহীনুর ইসলাম শানু
প্রকাশিত: জুলাই ২৯, ২০২৫, ০১:১৫ এএম
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভবন। ছবি- সংগৃহীত

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। সাফল্যের মাপকাঠি রাজস্ব বাড়াতে আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএফের পরামর্শে রাজস্বনীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আলাদা করার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এতে তীব্র আন্দোলনের মুখে পড়ে এনবিআর কর্তৃপক্ষ। অবশেষে ঐক্য পরিষদের আন্দোলন ঠেকাতে রাজস্ব প্রশাসকের অনেক কর্মীকে বাধ্যতামূলক অবসর ও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

নতুন করে চট্টগ্রামে গতকাল সোমবার আরও ৭০ জন কর্মকর্তাকে বদলির আদেশ দিয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউস। বিশেষ কৌশলে আন্দোলন ঠেকানো গেলেও কর্মপরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। অন্যদিকে ভীতিকর পরিবেশে কর্মী উৎসাহ না থাকায় রাজস্বের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সংশয় রয়েছে, বলেন একাধিক রাজস্বকর্মী। তারা বলেন, দুটি বিভাগের প্রশাসকদের মধ্যে ব্যাপক মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছে।

‘রাজস্ব প্রশাসনে অধিকতর গতিশীলতা আনয়ন এবং করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃজনের জন্য অনুসৃত ‘সুশাসন ও আধুনিক ব্যবস্থাপনা কাঠামো’র আওতায় রাজস্ব কর্মকর্তাদের বদলি করা হলো।’ গতকাল এই আদেশ দিয়েছেন চট্টগ্রামের কমিশনার অব কাস্টমস মোহাম্মদ শফি উদ্দিন।

তার আগে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ’ করায় এবার ১৪ জন কর্মকর্তাকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে সরকার। পাশপাশি ১১ কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নামে আন্দোলন প্রত্যাহারের পর চারজনকে বাধ্যতামূলক অবসর ও এক কমিশনারকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া এনবিআরের দুজন সদস্যসহ ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুদক।

এনবিআরের বিশেষ একটি সূত্র জানিয়েছে, সংস্কার আন্দোলনের শেষে প্রাণবন্ত কর্মপরিবেশ তৈরি হয়নি। যার কারণে কর্মীদের মানসিক বৈকল্য তৈরি হয়েছে। ফলে সম্ভাবনার বদলে ফের ঘাটতির দিকেই যাচ্ছে, বলেন রাজস্ব কর্মীরা। জাতীয় রাজস্ব আহরণ হুমকির মুখে পড়ছে বলে একই মত দিয়েছেন অর্থনীতি বিশেষজ্ঞরা।

অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে ‘রাজস্ব নীতি’ ও ‘রাজস্ব ব্যবস্থাপনা’ নামের দুটি পৃথক বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার থেকে বলা হয়েছে, এর মূল লক্ষ্য হলো করনীতি প্রণয়ন ও কর ব্যবস্থাপনার কাজ আলাদা করা। একই সঙ্গে দক্ষতা বাড়ানো, স্বার্থের সংঘাত হ্রাস ও দেশের করভিত্তি প্রসারিত করা।

তবে এনবিআর বিলুপ্তির প্রতিবাদে প্রথমে কলমবিরতি এবং পরে চেয়ারম্যানকে অবমুক্তির ঘোষণা দেন প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। সামষ্টিক অর্থনীতির এই ক্লান্তিকালে এনবিআর বিলুপ্তি নিয়েও তীব্র সমালোচনা তৈরি হয়।

এনবিআর বিলুপ্তির বিষয়ে সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে এনবিআর রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র ৭ দশমিক ৪ শতাংশ; এটি এশিয়ার মধ্যে অন্যতম সর্বনিম্ন। বিশ্বে কর-জিডিপির গড় অনুপাত ১৬ দশমিক ৬ শতাংশ। এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি মালয়েশিয়ায় এই অনুপাত ১১ দশমিক ৬ শতাংশ। দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে অন্তত ১০ শতাংশ কর-জিডিপির অনুপাত অর্জন করতেই হবে।

তবে ২০২৫-২৬ বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে সে লক্ষ্য পূরণ কঠিন হবে বলে জানিয়েছে ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্টস অব বাংলাদেশ (আইসিএবি)। আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মারিয়া হাওলাদার সম্প্রতি বলেন,  ‘নতুন অর্থবছরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, গত বছরের মূল লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৪১ লাখ কোটি টাকা। এটি চলতি বছরের চেয়ে ৪.২৫ শতাংশ বেশি। দেশের বিদ্যমান কর কাঠামো ও কর আদায় প্রক্রিয়ায় এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা কঠিন হবে।’

তবে চলতি অর্থবছর ২০২৫-২৬ অর্থবছরে সরকারের রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা দেশের মোট জিডিপির ৯ শতাংশের সমান। নতুন বাজেটে প্রস্তাবিত মোট রাজস্ব আয়ের মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৬৫ হাজার কোটি টাকা আসবে অন্যান্য উৎস থেকে বলা হয়েছে।

এদিকে, এনবিআর বিলুপ্তির বিষয়ে সরকারি ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তাই কর-জিডিপির অনুপাতের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এনবিআর পুনর্গঠন জরুরি। একই সংস্থা করনীতি প্রণয়ন ও নীতির বাস্তবায়ন করবে-এ অবস্থান সাংঘর্ষিক। সেই সঙ্গে এটা ব্যবস্থা হিসেবে অদক্ষ। দীর্ঘদিন ধরে দেশের ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করে আসছেন, নীতি প্রণয়নে রাজস্ব আহরণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। তারা বলছেন- ন্যায়বিচার, প্রবৃদ্ধি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা উপেক্ষা করা হয়েছে। তাই এনবিআর ভেঙে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগ গঠন শুধু প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়; বরং ন্যায়ভিত্তিক ও দক্ষ করব্যবস্থা প্রণয়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। শক্তিশালী নীতি নির্ধারণ ও স্বচ্ছ প্রশাসন বাংলাদেশের নাগরিকদের স্বপ্নপূরণে সহায়ক হবে।

বিলুপ্তির বিষয়ে সরকার যে ব্যাখ্যা দিচ্ছে সেই লক্ষ্য অর্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সাহাদাত সিদ্দিকী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহিবলের (আইএমএফ) পরামর্শে এনবিআর বিলুপ্ত করা হয়েছে। আইএমএফ থেকে ঋণ পাওয়ার বিলম্বের কারণও ছিল এ সংস্কার, তাই সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’ 

অধ্যাপক ড. মো. সাহাদাত সিদ্দিকী আরও বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করার পর থেকে রেভিনিউ পারফরমেন্স, রেভিনিউ জেনারেশন পারফরমেন্স ঋণাত্মক। আমরা রেভিনিউ সংগ্রহের ক্ষেত্রে অলরেডি ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছি। এখন যদি কোঅর্ডিনেশন ফেইলিউর হয়, তখন আরও বড় ধাক্কা লাগবে। হঠাৎ করে কিছু চাপিয়ে দিলে সেটির প্রভাব ভালো হয় না। কাস্টম ও শুল্কসহ বিভিন্ন ক্যাডারের কর্মকর্মতারা এটিকে গ্রহণযোগ্য মনে করবে না।’

তিনি বলেন, ‘কর জিডিপি বৃদ্ধির বিষয়ে আইএমএফে’র পরামর্শ রয়েছে। এ খাতে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। এজন্য রাজস্বনীতি এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনা আলাদা করা হয়েছে। তবে এ প্রক্রিয়াটি যদি আইএমএফ’র ঋণ নেওয়ার শুরু থেকে সংস্কার করা যেত, তাহলে সুন্দর সমাধান হতো। রাষ্ট্রের কর জিডিপি দেখে বোঝা যায়, কী পরিমাণ লুটপাট চলছে। এ দেশে একশ্রেণির ধনীরা সরকারকে লুটে খাচ্ছে।’

বদলি ও অস্থিরতার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এনবিআর সদস্য জিএম আবুল কালাম কায়কোবাদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘চাকরি থেকে অব্যাহতির বিষয়টি সরকারের ইস্যু এবং বদলির বিষয়টি এনবিআরের রুটিন ওয়ার্ক। প্রতি বছর জুনের শেষে সরকারি চাকরিজীবীদের বদলি শুরু হয়। কাজেই এটি ভিন্ন খাতে প্রবাহের সুযোগ নেই।’ বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

সরকারের নির্দেশনা আমলে না নেওয়ায় এনবিআরের তিনজন সদস্য ও একজন কমিশনারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠিয়েছে সরকার। অবসরপ্রাপ্তরা হলেন এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস নীতি ও আইসিটি) হোসেন আহমেদ, সদস্য (মূসক নীতি) ড. মো. আবদুর রউফ, সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) মো. আলমগীর হোসেন এবং কর-কমিশনার শাব্বির আহমেদ।

এনবিআরের মোট ১১ কর্মকর্তার দুর্নীতির অনুসন্ধানের ঘোষণা করেছে দুদক। তারা হলেন- এনবিআরের বৃহৎ করদাতা ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার আব্দুল রশীদ মিয়া, এনবিআরের সদস্য লুতফুল আজীম, এনবিআরের সিআইসি সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলমগীর হোসেন, ঢাকা কর অঞ্চল-১৬ এর উপ-কর কমিশনার মোহাম্মদ শিহাবুল ইসলাম এবং যুগ্ম কমিশনার মো. তারেক হাছান।

তালিকায় আরও আছেন, এনবিআরের আয়কর নীতি বিভাগের সদস্য এ কে এম বদিউল আলম। নিরীক্ষা, গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের অতিরিক্ত কমিশনার হাছান মুহম্মদ তারেক রিকাবদার, তিনি এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সভাপতি। ঢাকা-৮ কর অঞ্চলের অতিরিক্ত কমিশনার মির্জা আশিক রানা ও শাহরীন সুস্মিতা ঐক্য পরিষদের সহসভাপতি।