দিনের বেলায়ই ভূতুড়ে পরিবেশ রেলওয়ে হাসপাতালে ব্যবহার না হওয়ায় যন্ত্রপাতিতে ধুলার আস্তর
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অধীন সরকারি হাসপাতালগুলোর রোগীদের উপচেপড়া ভিড় লেগেই থাকে। অন্যদিকে রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালে রোগীর উপস্থিতি একেবারেই নগণ্য। শুধু রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলপোষ্যদের সেবার লক্ষ্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল ১শ শয্যাবিশিষ্ট রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালটি। তাই রোগীর সংখ্যা থাকত একেবারেই কম। এ অবস্থা থেকে বের হতে এবং হাসপাতালটিকে কর্মচঞ্চলতা বাড়াতে চলতি বছরই উদ্যোগ নেয় সরকার। করা হয় সবার জন্য উন্মুক্ত। কিন্তু হলে কী হবে, চিকিৎসক-রোগী কোনোটারই দেখা পাওয়া যায় না হাসপাতালটিতে। ফলে দিনের বেলাতেই একটা ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে হাসপাতাল প্রাঙ্গণটিতে। দিনের পর দিন অব্যবহৃত থাকার ফলে হাসপাতালের যন্ত্রপাতিতে পড়েছে ধুলার আস্তর। সরকারের সুনজর না থাকায় ওই এলাকায় একটি মাত্র সরকারি হাসপাতাল থাকলেও লোকজনকে বাধ্য হয়ে যেতে হয় জেনারেল হাসপাতালে। ফলে ওই হাসপাতালে রোগীর চাপ বাড়ে।
এলাকাবাসী বলছেন, সবকিছু সংস্কারের মতো যদি এই হাসপাতালটিও সংস্কার করে রোগীদের চিকিৎসার উপযোগী করে তোলা হতো তাহলে কমলাপুরসহ ওই এলাকার মানুষজনের আস্থার জায়গা হয়ে উঠতে পারত হাসপাতালটি।
চলতি বছরের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালগুলোতে রেলপথ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি সাধারণ জনগণও চিকিৎসাসেবা নিতে পারার জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের মধ্যে এ-সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম ও স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান নিজ নিজ দপ্তরের পক্ষে সমঝোতা স্মারকে সই করেন। সমঝোতা স্মারকের শর্ত অনুযায়ী, বাংলাদেশ রেলওয়ের ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালগুলোতে রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়েতে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলপোষ্য ও রেলওয়ের যাত্রী সাধারণের পাশাপাশি সাধারণ জনগণের জন্য চিকিৎসা সুবিধা উন্মুক্ত করা এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাথে যৌথভাবে চিকিৎসা দেওয়ার কথা। তবে মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী, রেলপোষ্য ও যাত্রী সাধারণের চিকিৎসাসংক্রান্ত সব সুযোগ-সুবিধা আগের মতোই বহাল থাকবে।
ওই সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জানানো হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে হাসপাতালের সব স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি এ সমঝোতা স্মারকের শর্ত মোতাবেক যৌথভাবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি কেন্দ্রীয় কমিটির ব্যবস্থাপনায় ব্যবহৃত/পরিচালিত হবে। বিদ্যমান জনবল কাঠামোর অধীনে নিয়োগ করা জনবলের প্রশাসনিক ও সংস্থাপনিক কার্যক্রম বাংলাদেশ রেলওয়ের আওতায় থাকবে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও রেলপথ মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত ইনভেন্টরি কমিটি কর্তৃক প্রস্তুতকৃত তালিকা অনুসারে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ হাসপাতালের সব অস্থাবর সম্পত্তি বুঝে নেবে এবং এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ, মেরামত, পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংযোজন ও বিয়োজনের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়ন করবে। সমঝোতা স্মারকের আওতায় রেলওয়ে হাসপাতালের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর সেবা প্রদান ফিবাবদ আদায়কৃত অর্থের ব্যবস্থাপনা সরকারি হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য বিধিবিধান অনুযায়ী হবে।
হাসপাতালগুলোর সার্বিক ব্যবস্থাপনার জন্য সচিব, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে এবং স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট অন্য সদস্যদের সমন্বয়ে একটি কেন্দ্রীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে এবং প্রতিটি হাসপাতালের জন্য পৃথক স্থানীয় যৌথ ব্যবস্থাপনা কমিটি থাকবে। এই ব্যবস্থাপনা কমিটির গঠন ও কার্যপরিধি সরকার কর্তৃক আদেশের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু সমঝোতা স্মারকটি কার্যত অকার্যকরই রয়ে গেছে ৩ মাস পার হয়ে গেলেও। হাসপাতালে রোগী তো দূরের কথা প্রয়োজনীয় চিকিৎসকই নেই।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একসময়ে কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর ছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের নিজস্ব হাসপাতালগুলো। মূলত রেলওয়ের কর্মচারী ও তাদের পরিবারের জন্য স্থাপিত হলেও এসব হাসপাতাল ওয়ার্ড, অপারেশন থিয়েটার, রোগ নির্ণয় ল্যাবসহ বেশকিছু আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গড়ে ওঠে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই জৌলুস হারিয়েছে। বর্তমানে অধিকাংশ রেলওয়ে হাসপাতালেই রোগীর দেখা মেলে না, অথচ সেগুলো এখন ‘সবার জন্য উন্মুক্ত’। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তারা দুষছেন চিকিৎসক সংকটকে। রেলওয়ে হাসপাতালের বিভিন্ন বিভাগেই নেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কাউকে সংযুক্তি আকারে দিলেও তারা তদবির করে বদলি হয়ে চলে যান অন্য জায়গায়। তাদের জায়গায় নতুন কাউকে নিয়োগও দেওয়া হয় না। যন্ত্রপাতির অকার্যকরতাও এই হাসপাতালে রোগী না আসার অন্যতম কারণ বলে অভিযোগ করে নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালটির এক কর্মী অভিযোগ করেন, এক সময়কার আধুনিক যন্ত্রপাতি এখন অচল। সংস্কার না হওয়ায় নেই কোনো রোগ নির্ণয়েরই ব্যবস্থা। রয়েছে ওষুধের স্বল্পতা ও অনিয়মও। পর্যাপ্ত সরকারি ওষুধের সরবরাহ না থাকায় রোগীদের বাইরে থেকে জরুরি ওষুধ কিনে আনতে হয়। সরকারি বরাদ্দ থাকলে সঠিকভাবে ব্যবহার বা বিতরণ নিয়েও অভিযোগ রয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, সবচেয়ে বড় কথা সাধারণ মানুষ জানেই না যে, রেলওয়ে হাসপাতালগুলো এখন সবার জন্য উন্মুক্ত। প্রচারের অভাবে এখানে রোগী আসে না। ফলে সরকারিভাবে অন্যান্য আধুনিক হাসপাতাল ও বেসরকারি ক্লিনিকের দিকে রোগীরা ঝুঁকছেন।
সরেজমিনে হাসপাতালটিতে দেখা যায়, সরকারের বরাদ্দ খরচ হচ্ছে ঠিকই কিন্তু রোগী নেই। হাসপাতালের অবকাঠামো, বিদ্যুৎ, পানি, কর্মচারীর বেতন সবই চলছে নিয়মিত, অথচ সেবাপ্রাপ্তি প্রায় শূন্যের কোঠায়। এটি একদিকে যেমন রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয়, অন্যদিকে দরিদ্র রোগীরা একটি সাশ্রয়ী সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাসপাতাল প্রাঙ্গণে অলস বসে থাকা এক দারোয়ান বলেন, এখানে শুধু বসে থাকা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই। রোগীদের ভিড় না থাকায় আমাদের আসলে কোনো কাজ থাকে না। ফলে প্রতিদিন সকালে আসি নিয়ম করে ডিউটি করে সন্ধ্যায় চলে যাই। মাস শেষে বেতন নেই।
প্রবেশপথে সুন্দর মনোরম পরিবেশ থাকলেও রোগী না থাকায় এটি সম্পূর্ণ অব্যবহৃতই রয়ে যায় প্রতিদিন। হাসপাতালের অভ্যন্তরের কাঠামো, ওয়ার্ড, ল্যাবরেটরিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম থাকলেও তার কোনো কাজেই আসছে না। ১০০ শয্যার হাসপতালটিতে রয়েছে মেডিকেল ওয়ার্ড, সার্জারি ওয়ার্ড, শিশু ওয়ার্ডও। এমনকি রয়েছে আইসিইউ, এনআইসিইউও। কিন্তু পর্যাপ্ত পরিকল্পনার অভাবে এগুলো বেশির ভাগ সময়ই অব্যবহৃত থাকে স্বীকার করে রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা একটা উদ্যোগ নিয়েছিলাম হাসপাতালটিকে সচল করতে। কিন্তু সাধারণ মানুষের এখনো এটির ওপর আস্থা তৈরি হয়নি। আমরা এ ব্যাপারে কাজ করছি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও আমাদের সাহায্য করছে। দেখা যাক কী হয়।
কেন হাসপাতালটিতে রোগী কম আসে জানতে চাইলে হাসপাতালটির পরিচালক ডা. মো. আনোয়ার হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, রেলওয়ে হাসপাতালটি দীর্ঘদিন ধরে মূলত রেল কর্মচারীদের সেবার জন্য ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। কিন্তু এখন আমরা এটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করেছি। তবে প্রচারের ঘাটতি, চিকিৎসক ও আধুনিক যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা এবং জনগণের মধ্যে আস্থার অভাবের কারণে রোগীর সংখ্যা এখনো আশানুরূপ নয়। তিনি বলেন, মানুষ এখনো জানে না যে, রেলওয়ে হাসপাতালেও গুণগত চিকিৎসাসেবা পাওয়া সম্ভব। অনেকেই ধারণা করেন, এটি কেবল রেলওয়ে কর্মীদের জন্যই সীমিত। পাশাপাশি কিছু ওয়ার্ড ও ল্যাবরেটরি দীর্ঘদিন অচল থাকার ফলে পূর্ণাঙ্গ সেবা দিতে পারছি না, যা রোগীদের নিরুৎসাহিত করে। তবে আমরা এরই মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ে চিকিৎসক নিয়োগ, যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ ও ইনফ্রাস্ট্রাকচার উন্নয়নের কাজ শুরু করেছি। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের জন্য তথ্য প্রচার কার্যক্রম জোরদার করার পরিকল্পনা রয়েছে। আশা করি, খুব শিগগিরই রেলওয়ে হাসপাতাল আবারও রোগীদের আস্থা ফিরে পাবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রেলওয়ে হাসপাতালগুলোকে কার্যকর করতে হলে চাই নতুন চিকিৎসক নিয়োগ, আধুনিক যন্ত্রপাতির মেরামত ও হালনাগাদ, ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিতকরণ এবং সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি। স্থানীয়ভাবে তথ্য প্রচার, সরকারি স্বাস্থ্য খাতের সঙ্গে সমন্বয় এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করলে এসব হাসপাতাল আবারও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। এসব স্বাস্থ্য বিভাগ করছে জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা কাজ শুরু করেছি। শুধু ঢাকা রেলওয়ে হাসপাতাল নয়, দেশের সব রেলওয়ে হাপসাতালকে সচল করতে আমাদের কাজ চলমান।