ঢাকা শুক্রবার, ০৮ আগস্ট, ২০২৫

অবৈধ পথে ইউরোপে যাত্রায় মৃত্যু

তাদের নামহীন সমাধিতে শুধুই লেখা ‘অভিবাসী’

আরিয়ান স্ট্যালিন
প্রকাশিত: আগস্ট ৮, ২০২৫, ০২:১৮ এএম

২০২১ সালের ২০ জুলাই, মধ্যরাত। লিবিয়ার উপকূল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার জন্য একটি ছোট ট্রলারে উঠেছিলেন প্রায় ৯০০ যাত্রী। তিল ধারণের জায়গা ছিল না সেই ট্রলারে। গাদাগাদি করে বসে থাকা ট্রলারের যাত্রীদের দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। যাত্রীদের ভিড়ে ছিলেন বাংলাদেশের মাদারীপুরের নাসির মাতুব্বর। ট্রলারের সব যাত্রীর মতো নাসির মাতুব্বরের লক্ষ্য ছিল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালিতে প্রবেশ করবেন।

আর্থিক সচ্ছলতার আশায় স্বপ্নের ইউরোপে পৌঁছাতে যে কোনো পরিণতির জন্য তৈরি ছিলেন তিনি। তার সামনে নিয়তির দুটি দরজা খোলা ছিলÑ হয় সাগরে ডুবে মৃত্যু, নয়তো ইতালিতে পৌঁছানো। সেদিনের যাত্রায় উত্তাল ভূমধ্যসাগরে ট্রলার ডুবে প্রাণ গিয়েছিল অনেকের। সে তালিকায় ছিলেন অভিবাসনপ্রত্যাশী ১৭ জন বাংলাদেশিও। ট্রলারে করে অবৈধভাবে ইউরোপে যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে মারা যান নাসির মাতুব্বরসহ অনেকেই। স্বপ্নের ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে তারা বরণ করেন নির্মম মৃত্যু। পরে সাগরে ভাসতে থাকা এসব মরদেহ উদ্ধার করে তিউনিসিয়ান কোস্ট গার্ড। অবৈধ পথে ইউরোপে প্রবেশ করতে গিয়ে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেওয়া এসব মানুষের বিশাল সমাধিক্ষেত্র ছড়িয়ে আছে লিবিয়া, ইতালি, গ্রিসসহ বিভিন্ন দেশে। নাম-পরিচয় জানতে না পারায় তাদের সমাধির এপিটাফে লেখা হয় একটি শব্দÑ ‘অভিবাসী’। যুগের পর যুগ পেরিয়ে গেলেও তাদের পরিচয় থেকে যায় অজানা। নাম নেই, শুধু লেখা ‘অভিবাসী’; ইউরোপগামীদের নামহীন সমাধি। এসব নামহীন সমাধির কোনো একটি বাংলাদেশের মাদারীপুরের নাসির মাতুব্বরের।

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যাওয়ার পথে গত ৮ বছর ৯ মাসে ১৫৫ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ তথ্য আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) সংগ্রহ করেছে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১১তম স্থানে রয়েছে। সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন সিরিয়ার নাগরিকÑ ৭৯১ জন। শীর্ষ ২০ দেশের তালিকায় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও সপ্তম স্থানে রয়েছে আফগানিস্তান এবং ১৭তম স্থানে রয়েছে পাকিস্তান। এই সময়ের মধ্যে আফগানিস্তানের ২৭০ জন এবং পাকিস্তানের ৯১ জন নাগরিক মারা গেছেন। এরা সবাই ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে ভূমধ্যসাগর পাড়ি বা স্থল সীমান্ত অতিক্রমের সময় মারা গেছেন।

ইউরোপে অনিয়মিত অভিবাসনের জন্য সবচেয়ে ব্যস্ত ও বিপজ্জনক পথ হিসেবে আবারও সামনে এসেছে সেন্ট্রাল মেডিটেরেনিয়ান রুটের নাম। আর এই রুটে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি অবৈধ অভিবাসী লিবিয়া হয়ে ইতালিতে প্রবেশ করছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত পর্যবেক্ষণ সংস্থা ফ্রন্টেক্সের ১০ জুন প্রকাশিত সর্বশেষ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে এই রুটে অভিবাসী প্রবেশের হার ১২ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৯ হাজার ৩০০ জনে। এর মধ্যে লিবিয়া থেকে ইতালিতে পৌঁছেছেন প্রায় ২০ হাজার ৮০০ জন, যা আগের বছরের তুলনায় ৮০ শতাংশ বেশি। ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসেই অন্তত ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি এই বিপজ্জনক রুট ধরে ইতালিতে পৌঁছেছেন। গত এক দশকে এই রুট ধরে অন্তত ৭০ হাজার বাংলাদেশি ইউরোপ পৌঁছেছেন। ফ্রন্টেক্স জানায়, লিবিয়া থেকে ইউরোপে অবৈধভাবে পাড়ি জমানো অভিবাসীদের বড় অংশই বাংলাদেশি নাগরিক। এরপর রয়েছে মিশরীয় ও আফগান নাগরিকেরা। এই বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে অনেকেই প্রাণ হারাচ্ছেন, আবার অনেকে পাচারকারী চক্রের ফাঁদে পড়ছেন।

প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ইউরোপে মোট অনিয়মিত অভিবাসনের সংখ্যা ২০ শতাংশ কমে দাঁড়িয়েছে ৭৫ হাজার ৯০০ জনে। ফ্রন্টেক্স জানিয়েছে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় ও পশ্চিম আফ্রিকান রুটে উল্লেখযোগ্য হারে অভিবাসন কমেছে। পশ্চিম বলকান রুটে ৫৩ শতাংশ, পূর্ব সীমান্তে ৫০ শতাংশ এবং পশ্চিম আফ্রিকান রুটে ৪১ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। তবে সেন্ট্রাল মেডিটেরেনিয়ান রুট এখনো ইউরোপের সবচেয়ে ব্যবহৃত পথ। বর্তমানে ইউরোপে অনিয়মিত ও অবৈধ প্রবেশকারীদের ৩৯ শতাংশই এই রুট ব্যবহার করছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পূর্ব ভূমধ্যসাগরীয় রুটে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। লিবিয়া থেকে গ্রিসের ক্রিট দ্বীপমুখী একটি নতুন করিডর গড়ে উঠেছে, যা এখন সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচারকারী নেটওয়ার্কগুলো নজরদারি কম থাকায় আগের রুট বাদ দিয়ে নতুন এই পথ বেছে নিচ্ছে। পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় রুটেও অবৈধ অভিবাসনের প্রবণতা বেড়েছে। এই রুটে অভিবাসন ১৯ শতাংশ বেড়েছে এবং শুধু জুন মাসেই অবৈধ প্রবেশ দ্বিগুণ হয়েছে। আলজেরিয়া থেকে এই পথে যাত্রার হার ৮০ শতাংশ বেড়েছে। সোমালিয়ান ও আফ্রিকান অভিবাসীরা এই রুট ব্যবহার করে। ফ্রন্টেক্স একে পাচারকারীদের নতুন কৌশল বলেছে। যুক্তরাজ্যে প্রবেশের জন্য ইংলিশ চ্যানেল রুট ব্যবহার করে অবৈধ অভিবাসনের চেষ্টাও বেড়েছে ২৩ শতাংশ। জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত এই পথে ৩৩ হাজার ২০০ জন ইংল্যান্ডে প্রবেশের চেষ্টা করেছেন। তারা মূলত ফ্রান্স হয়ে এই রুটে যাত্রা করেছেন।

২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে অবৈধ অভিবাসনের সংখ্যা কিছুটা কমলেও মানবিক ট্র্যাজেডি কমেনি। ফ্রন্টেক্স ও আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছে, এ সময় শুধু ভূমধ্যসাগরেই ৭৬০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। ট্রলারে ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার সময় এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাদের মধ্যে বাংলাদেশিও রয়েছেন। অভিবাসন ঠেকাতে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। বর্তমানে ফ্রন্টেক্সের প্রায় তিন হাজার কর্মকর্তা ইউরোপের বিভিন্ন সীমান্তে মোতায়েন রয়েছেন। তবে পাচারকারী চক্রগুলো দ্রুত নতুন রুট তৈরি করায় সীমান্ত নজরদারি কঠিন হয়ে পড়ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

২০২৪ সালকে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বছর হিসেবে অভিহিত করে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা (আইওএম)। বছরটিতে বিশ্বজুড়ে রেকর্ড প্রায় ৯ হাজার অভিবাসনপ্রত্যাশী প্রাণ হারিয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যায় শীর্ষে ছিল এশিয়া। কাতারভিত্তিক গণমাধ্যম আল-জাজিরা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। আইওএম বলেছে, ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে যাত্রাপথে কমপক্ষে ৮ হাজার ৯৩৮ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন। ২০১৪ সাল থেকে অভিবাসীদের মৃত্যুর হিসাব রাখতে শুরু করে সংস্থাটি। সেই হিসাবে ২০২৪ সালে সর্বোচ্চসংখ্যক অভিবাসী মারা গেছেন। জাতিসংঘ মৃত্যুর এই সংখ্যাকে ‘অগ্রহণযোগ্য এবং প্রতিরোধযোগ্য’ বলে অভিহিত করে। ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে অন্তত ২০০ জন বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। ২০২০ সাল থেকে অভিবাসন রুটে মৃত্যুর সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়েছে। আইওএমের মিসিং মাইগ্রেন্ট প্রজেক্ট অনুসারে, শুধু এশিয়া মহাদেশেই কমপক্ষে ২ হাজার ৭৭৮ জন অভিবাসী মারা গেছেন। সংখ্যাটি ২০২৩ সালের চেয়ে ৬২৪ জন বেশি। মৃতের হিসাবে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভূমধ্যসাগর। ২ হাজার ৪৫২ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী মারা গেছেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে। অভিবাসন রুটে মৃত্যুর তৃতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যা আফ্রিকায় রেকর্ড করা হয়েছে। যেখানে ২ হাজার ২৪২ জন মারা গেছেন। আমেরিকা মহাদেশের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী কমপক্ষে ১ হাজার ২৩৩ জন অভিবাসী মারা গেছেন। অভিবাসীদের মৃত্যু এবং নিখোঁজের প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

আইওএমের তথ্যমতে, ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নিজ দেশে বা বিভিন্ন অভিবাসন রুটে বিশ্বজুড়ে ৭২ হাজার অভিবাসী মারা গেছেন অথবা নিখোঁজ হয়েছেন। এই ১১ বছরে ৫২ হাজারেরও বেশি মানুষ সংকটকবলিত দেশগুলো থেকে পালিয়ে বাঁচতে গিয়ে বিভিন্ন অভিবাসন রুটে মারা গেছেন। 

২০২১ সালে আফগানিস্তানে রাজনৈতিক অস্থিরতার পরে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ মারা গেছেন। বাংলাদেশ ঢোকার সময় এবং নৌকাডুবি মিলিয়ে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অন্তত ৩ হাজার ১০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গেছে। আইওএম বলছে, মারা যাওয়া বা নিখোঁজ অভিবাসীদের প্রতি চারজনের মধ্যে একজন সংকটকবলিত দেশের নাগরিক৷

রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক তাসনিম সিদ্দিকী জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে প্রবাসে বাংলাদেশি অভিবাসী শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা রেকর্ড ছোঁয়। ওই বছরে ৪ হাজার ৮১৩টি মৃতদেহ দেশে ফেরত আনা হয়, যা আগের বছরের তুলনায় ৫ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৫৫২।

গ্রিসের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এভরস অঞ্চলের একটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত এক নির্জন কবরস্থান। এভরস অঞ্চলটি গ্রিস-তুরস্ক সীমান্তবর্তী, যা ইউরোপে অনুপ্রবেশের অন্যতম স্থলপথ হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রায় প্রতিদিনই নাম-পরিচয়হীন লাশের দাফন হয়। এসব লাশ আর কারো নয়, অবৈধ পথে ইউরোপে পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হওয়া হতভাগ্যদের। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, গত ১১ বছরে সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে এবং বিশাল এভরস নদীতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন ৩ হাজারেরও বেশি মানুষ। তাদের অধিকাংশেরই পরিচয় অজানা রয়ে গেছে।

অভিবাসীদের ইউরোপে প্রবেশের আরেকটি প্রধান পথ হলো ইতালির দক্ষিণাঞ্চলীয় ল্যাম্পেদুসা দ্বীপ। উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়াসহ বিভিন্ন দেশ থেকে অনেকে রাবারের নৌকায় করে এই পথ পাড়ি দেন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই নৌকাডুবির কারণে অনেকেই জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন সাগরের বুকে। যাদের মরদেহ পাওয়া যায়, তাদের দাফন করা হয় দ্বীপটির স্থানীয় কবরস্থানে। এসব সমাধিতেও পরিচয়ের বদলে শুধু লেখা থাকেÑ ‘অভিবাসী’।

এ ছাড়া আফ্রিকার উপকূলবর্তী দেশ মৌরিতানিয়ায় অভিবাসীদের আরেকটি কবরস্থান রয়েছে, যার নাম সাঈদ কবরস্থান। এখানে দাফন করা হয় সেই সব ভাগ্যাহত মানুষকে, যারা ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা করেও নিজ দেশের জলসীমা পেরোতে পারেননি। ২০২৪ সালে মৌরিতানিয়ার উপকূল থেকে উদ্ধার করা হয় পাঁচ শতাধিক মরদেহ। আর ২০২৫ সালের প্রথম কয়েক মাসেই মিলেছে আরও শতাধিক মৃতদেহ।

এসব অচেনা কবর হয়ে উঠেছে মানবিক বিপর্যয়ের নীরব সাক্ষী। তাদের নাম নেই, পরিচয় নেই, আছে শুধু একটি পরিচায়ক শব্দÑ ‘অভিবাসী’।