ঢাকা সোমবার, ২৫ আগস্ট, ২০২৫

ডেঙ্গুতে মৃত্যু থামছেই না

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২৫, ২০২৫, ০১:১৩ এএম

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মিছিল যেন থামছেই না। মাত্র ৪ দিনের ব্যবধানে মরণঘাতী রোগটিতে আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেছে ১০ জনের। গত ২১ আগস্ট বৃহস্পতিবার ডেঙ্গু প্রাণ কেড়ে নেয় ৫ জনের। এর এক দিন পর ২৩ আগস্ট শনিবার আরও ৪ জনের মৃত্যু হয়। আর গতকাল রোববার মৃত্যু হয় ১ জনের। এ নিয়ে চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ১১৫ জনে। এমন পরিস্থিতিতে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জোর তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। 

গতকাল রোববার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোলরুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, একই সময় সারা দেশে ৪৩০ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মধ্যে বরিশাল বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৭৯ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৫৪ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৫৭ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬৩ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪৬ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১২ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৪২ জন, রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) তিনজন, সিলেট বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) দুইজন রয়েছে।  

অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২৪ ঘণ্টায় ৪৫৫ ডেঙ্গুরোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। চলতি বছর এ যাবৎ মোট ২৬ হাজার ২৩৬ রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছে। চলতি বছরের ২৪ আগস্ট পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ২৮ হাজার ৬৩২ জন। এর মধ্যে ৫৯ দশমিক দুই শতাংশ পুরুষ এবং ৪০ দশমিক আট শতাংশ নারী রয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরে এ যাবৎ ডেঙ্গুতে মোট ১১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। 

সাধারণত জুন-জুলাই মাসকে বলা হয় ডেঙ্গুর প্রজনন মৌসুম। তবে বর্ষাকাল আরেকটু বিস্তৃত হলে আগস্ট-সেপ্টেম্বরেও থাকতে পারে এর প্রভাব। কিন্তু চলতি বছরের প্রায় পুরোটা সময় করোনাভাইরাসের দাপটের সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে ছিল ডেঙ্গুর দৌরাত্ম্য। প্রতিদিনই আক্রান্ত হচ্ছে নতুন নতুন রোগী। হাসপাতালে ভর্তিদের মধ্যে কেউ কেউ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরলেও বেশির ভাগই কাতরাচ্ছে জ্বরে। সিটি করপোরেশন লোক দেখানো পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করলেও কার্যত মশা নিয়ন্ত্রণ কিছুই হচ্ছে না বলে অভিযোগ নগরবাসীর। আর সিটি করপোরেশন বলছে, নগরবাসীর অসচেতনতার কারণেই অনেক চেষ্টায়ও নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিস মশা। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডেঙ্গু জ্বরের জীবাণু বহন করে এডিস মশা। এই জাতের মশা নালা-নর্দমার নোংরা পানিতে জন্মায় না, বরং জন্মায় মানুষের ঘরের ভেতরে ও আশপাশে জমে থাকা অপেক্ষাকৃত পরিষ্কার পানিতে। ছাদে ও বারান্দায় জমে থাকা বৃষ্টির পানিতে, গাছের টব, ডাবের খোসা ইত্যাদি আধারে জমে থাকা পানিতে। বর্ষাকালে প্রায়ই থেমে থেমে বৃষ্টি হয় বলে বিভিন্ন স্থানে পানি জমে থাকে। তাই জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি ঘটে থাকে এবং এটাকেই ডেঙ্গু জ্বরের মৌসুম বলা হয়। প্রাকৃতিকভাবে জুন থেকেই শুরু হয় ডেঙ্গুর জীবাণু বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ঋতু। 

চলতি মাসে ডেঙ্গুর এই সংক্রমণ পরিস্থিতি শঙ্কা জাগাচ্ছে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডাক্তার লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এখন যে পরিস্থিতি আমরা দেখছি, তাতে এটাকে সারা বছরের স্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করাই সমীচীন। এই রোগ সংক্রমণ ও বিস্তারের প্রকৃতি লক্ষ করলে এটা এড়ানোর কিছু উপায় আমরা সহজেই অবলম্বন করতে পারি। সেটা হলোÑ বাসাবাড়ির ভেতরে ও আশপাশে পানি জমতে না দেওয়া, যাতে এডিস মশার বংশবিস্তার ঠেকানো যায়। দ্বিতীয়ত, মশার কামড় এড়ানোর জন্য সতর্ক থাকা, বাসা মশামুক্ত রাখার চেষ্টা করা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা। বিশেষভাবে সতর্ক থাকা প্রয়োজন শিশুদের ব্যাপারে। তাদের খালি গায়ে না রাখা, কেননা এডিস মশা সাধারণত শরীরের উন্মুক্ত অংশে বসে। 

বিশেষজ্ঞ ডা. সালেহ মাহমুদ তুষার বলেন, আমরা বরাবরই বলে আসছি ডেঙ্গু প্রতিরোধে একটি সমন্বিত পরিকল্পনা জরুরি। যা বছর শুরুর আগেই করতে হয়। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে আমরা ২০১৯-এর ডেঙ্গু মহামারির পরে এটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। এটি এখন শুধু নগরের রোগ নয়। এটি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ায় এটি এখন সারা বছরই থাকছে। এ কারণেই কিন্তু কিউলেক্স মশার প্রাদুর্ভাব ঘটেছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের একটি জায়গায় প্রায় ৯শর বেশি কিউলেক্স মশার প্রজননস্থল পাওয়া গেছে। সিটি করপোরেশনগুলো প্রতিদিনই মশা প্রতিরোধে নানা ধরনের লম্ফঝম্প করে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই চোখে পড়ে না। এ ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় নিয়মিত মশানিধন অভিযান পরিচালনা করা।

প্রজনন মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই উভয় সিটি করপোরেশনকে জরিপ চালিয়ে যেসব এলাকায় এডিস মশার ঘনত্বের সূচক বেশি পাওয়া যাবে, সেসব এলাকা রেড জোন চিহ্নিত করে মশার ওষুধ ছিটানো, ওইসব এলাকার বাসাবাড়িগুলোতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা ও সর্বোপরি সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার কাজটি সিটি করপোরেশনকে নিয়মিত করতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সচেতনতা জরুরি। বিশেষ করে নিজেদের বাড়ির গাছের টব, পরিত্যক্ত টায়ার, প্লাস্টিকের ড্রাম, বালতি, পানির চৌবাচ্চা ইত্যাদিতে যেন পানি জমে না থাকে, সে জন্য সবাইকে সতর্ক হতে হবে। 

এর আগে ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে এক লাখ এক হাজার ২১৪ জন এবং ডেঙ্গুতে মোট ৫৭৫ জনের মৃত্যু হয়। ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়, পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয় মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।