একটি সংশোধন ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে বাংলাদেশ জেলের নাম পরিবর্তন করে ‘কারেকশন সার্ভিস বাংলাদেশ’ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। তিনি বলেন, কারা বিভাগ সংশ্লিষ্ট আইনকানুন যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কারেকশন সার্ভিস অ্যাক্ট ২০২৫-এর খসড়া চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই কারাগার হোক একটি কারেকশনাল সার্ভিস। এখানে যারা আসবে, তারা শুধুই বন্দি হয়ে ফিরে যাবে না, বরং সংশোধিত মানুষ হিসেবে সমাজে ফিরতে পারবে।’
গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর পুরান ঢাকায় কারা অধিদপ্তরের সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।
বছরের পর বছর ধরে কারাগারগুলো জনবলের সংকটে রয়েছে জানিয়ে আইজি প্রিজন বলেন, সম্প্রতি সরকার ১ হাজার ৮৯৯ জন নতুন জনবল নিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে। এ ছাড়া আরও দেড় হাজার জনবল নিয়োগের প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। নতুন নিয়োগ এলে কারাগারের ভেতরের নিরাপত্তা ও প্রশাসনিক কাজ আরও সহজ হবে।
জেল পলাতক আসামি ও লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্রের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গত বছর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের চূড়ান্ত দিন ৫ আগস্ট দেশের বিভিন্ন জেলখানা থেকে ২ হাজার ২০০ বন্দি পালিয়েছে। তাদের মধ্যে কিছু ধরা পড়লেও এখনো ৯ জঙ্গিসহ ৭০০ জনের বেশি ধরা পড়েনি। এ ছাড়া, লুট হওয়া ২৯টি অস্ত্র উদ্ধারে কাজ করা হচ্ছে। লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।
ধারণক্ষমতার চেয়ে অধিক বন্দির বিষয়ে তিনি বলেন, ধারণক্ষমতার অধিক বন্দি থাকায় নতুন দুটি কেন্দ্রীয় কারাগার ও চারটি জেলা কারাগার চালু করা হয়েছে। এ ছাড়া বন্দিদের জন্য কেরানীগঞ্জে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মাধ্যমে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীও সেবা নিতে পারবেন। বন্দিদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি মাথায় রেখে বিভিন্ন কারাগারে স্থান সংকুলান সাপেক্ষে নানাবিধ খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানাবিধ মননচর্চার সুবিধা দেওয়া হচ্ছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশব্যাপী সব কারাগার কারা অধিদপ্তরের নিজস্ব ফাইবার নেটওয়ার্কের আওতায় আনা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কর্মস্থলে উপস্থিতি নিশ্চিতের জন্য ডিজিটাল অ্যাটেনডেন্ট সিস্টেম এবং টিম ট্রেকার্স চালু করা হয়েছে। কমপ্রিহেনসিভ মোবাইল জ্যামিং সিস্টেম, বডি স্ক্যানার, লাগেজ স্ক্যানার, গ্রাউন্ড সুইপিং মেশিন ও মোবাইল ডিটেক্টর কারা নিরাপত্তায় ব্যবহার করা হচ্ছে। এআই-নির্ভর সিসি ক্যামেরার পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ডিউটিসমূহে দায়িত্বরতদের বডি ক্যামেরা ব্যবহারের প্রচলন করা হয়েছে।
বন্দিদের টেলিফোন কল ও দেখা-সাক্ষাতের বিষয়টি ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সেবাগ্রহীতাদের যেন কোনোরূপ হয়রানির শিকার হতে না হয় এবং একই সঙ্গে নিবিড় নজরদারিও বজায় রাখা যায়। আমরা এ জন্য এআই-নির্ভর তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছি। এ ছাড়া হটলাইন সেবা (১৬১৯১) চালু করা হয়েছে, যার মাধ্যমে সেবা গ্রহণকারীরা বন্দি সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কিছু তথ্য আদান-প্রদান করতে পারছে।’
কারাগারে রাজনৈতিক বন্দিদের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে রাজনৈতিক বা ভিআইপি বন্দি বলে কিছু নেই। এখানে রাজনৈতিক কোনো মামলা নেই, এখানে হচ্ছে বিভিন্ন অভিযোগ। কেউ মারামারি, কেউ গণহত্যা, কেউ হত্যা মামলার আসামি। আমার জায়গা থেকে রাজনৈতিক আইডেন্টিফিকেশন দিয়ে আলাদা করার কোনো সুযোগ নেই। আমরা মামলার গুরুত্ব বা ধারা অনুসারে আলাদা করছি। কারাগারে ভিআইপি বন্দি বলে কিছু নেই। এটা হচ্ছে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি। বর্তমানে ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দি আছেন ১৬৩ জন। এ ছাড়া ডিভিশন আবেদন করে পাননি এমন বন্দি আছেন ২৮ জন।’
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বন্দিদের খাবারের মেন্যুতে প্রোটিনের পরিমাণ এরই মধ্যেই স্বল্প পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে এবং তা যৌক্তিক পর্যায়ে বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। সকালের নাশতা এবং বিশেষ দিবসের জন্যও খাদ্য বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বন্দিদের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কেরানীগঞ্জে ‘কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল’ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীও সেবা গ্রহণ করতে পারবেন। বন্দিদের সংশোধনের নিমিত্তে ধর্মীয় শিক্ষাসহ নানাবিধ কাউনসেলিংয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
আইজি প্রিজন বলেন, ‘কারা বিভাগে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি ঠেকাতে প্রযুক্তিনির্ভর স্বচ্ছ ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। এতে দালালচক্র দুর্বল হওয়ার পাশাপাশি ভুয়া পরীক্ষার্থীদেরও শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। কারা বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি এবং সব নিয়মবহির্ভূত বিষয়েও আমাদের অবস্থান অত্যন্ত কঠোর। বিগত এক বছরে বিভিন্ন অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বাধ্যতামূলক অবসর, ৩৪ জনকে চাকরিচ্যুত, ৪৪০ জনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থাসহ ১৭২ জনকে প্রশাসনিক কারণে বিভাগের বাইরে বদলি করা হয়েছে।’
কারাগারগুলোতে চিকিৎসাব্যবস্থা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘আমাদের কারা অধিদপ্তরে লিস্টেট ডাক্তার আছেন ১৪১ জন। এর মধ্যে কর্মরত আছেন দুজন। এ ছাড়া সিভিল সার্জন থেকে ১০৩ জন নিয়োগকৃত আছেন, যারা প্রয়োজনে আসেন। তবে এটা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আমরা এটা নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। এটি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করছি। আমাদের অ্যাম্বুরেন্সেরও স্বল্পতা আছে।’
এক বছরে কারাগার সংশ্লিষ্ট সংস্কার এবং উন্নয়নমূলক কার্যক্রম তুলে ধরে আইজি প্রিজন বলেন, ‘মামলাসহ নানা জটিলতা অতিক্রম করে দীর্ঘ এক যুগ পরে সিনিয়র জেল সুপারসহ সব পদবিতে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা হয়েছে, যা প্রশাসনে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনতে সহায়তা করছে। এ ছাড়া নিয়োগবিধি সংক্রান্ত জটিলতায় অনেকগুলো পদে নিয়োগ ও পদায়ন করা সম্ভব হচ্ছিল না, তা-ও যুগোপযোগী করে নতুন নিয়োগবিধি অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হয়েছে। কারা বিভাগের পোস্টিং বাণিজ্যের বহুল প্রচলিত অভিযোগগুলো আমলে নিয়ে বর্তমানে সব গুরুত্বপূর্ণ পদে মেধা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে সৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পদায়ন করা হচ্ছে এবং তা চলমান।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন