পুরো ঘটনাটাই যেন নাটকের মঞ্চ বা সিনেমার পর্দায় ঘটা দৃশ্যের মতো। ফুলে ফুলে সাজানো কোনো বিয়ের মঞ্চ নয়; হাসপাতালের বেডই হয়ে উঠল নবদম্পতির জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় আসর। সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে বরের হাত-পায়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা, তবু থেমে থাকেনি বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। চিকিৎসাধীন অবস্থায় থেকেও হাসপাতালের ভেতরেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন এক হিন্দু দম্পতি। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই দুই হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা আনন্দ সাহা কনে অমরিতা সরকারের মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দেন। পরিবার-স্বজনের উদ্যোগে এভাবেই সম্পন্ন হলো ব্যতিক্রমী এক বিয়ে। ঘটনাটি ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার রাতে মানিকগঞ্জ শহরের আফরোজা বেগম জেনারেল হাসপাতালে।
বছরখানেক আগে আনন্দ সাহা ও অমরিতা সরকারের পরিচয়ের পর ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে প্রেমের সম্পর্ক। পরে দুই পরিবারের সম্মতিতে তাদের বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারিত হয় এ বছরের ১৫ ডিসেম্বর। কিন্তু হঠাৎ ঘটে যাওয়া এক দুর্ঘটনায় বদলে যায় সব পরিকল্পনা। গত ৭ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে মোটরসাইকেলে মানিকগঞ্জে ফেরার পথে ট্রাকের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন আনন্দ। তার দুই হাত ও একটি পা ভেঙে যায়, কোমরে লাগে প্রচ- চোট। দুর্ঘটনার পর ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার পর তাকে মানিকগঞ্জের একটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এখনো তিনি বিছানা থেকে উঠতে পারেন না; চলাফেরাতেও অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয়।
ভালোবাসার মানুষের এমন সংকটময় সময়ে পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন অমরিতা সরকার। শুধু পাশে থাকাই নয়, অসুস্থ আনন্দকে হাসপাতালে একা রাখতে চাননি তিনি। তাই দুই পরিবারের আলোচনায় বিয়ের আয়োজন এগিয়ে আনা হয়। গত বৃহস্পতিবার রাতে মানিকগঞ্জ শহরের ওই বেসরকারি হাসপাতালের হলরুমেই সম্পন্ন হয় তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে হাসপাতালের সেই বিয়ের ছবি। এতে দেখা যায়, হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে থাকা অবস্থাতেই দুই হাতে ব্যান্ডেজ বাঁধা আনন্দ কনের মাথায় সিঁদুর পরিয়ে দিচ্ছেন। ধর্মীয় আচার মেনেই সম্পন্ন হয় বিয়ে। উপস্থিত ছিলেন দুই পরিবারের কয়েকজন ঘনিষ্ঠজন।
আনন্দ সাহা মানিকগঞ্জ শহরের চান মিয়া লেন সড়কের বাসিন্দা, বাবা অরবিন্দ সাহা স্থানীয় ব্যবসায়ী। শহরে তার কয়েকটি ব্যবহারিক পণ্যের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। নববধূ অমরিতা সরকার ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী গ্রামের মেয়ে। তিনি বর্তমানে মানিকগঞ্জ শহরের খানবাহাদুর আওলাদ হোসেন খান কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। মানিকগঞ্জ শহরের আফরোজা বেগম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আনন্দ সাহা।
হাসপাতালের মেডিকেল অ্যান্ড ইউনিট প্রধান সিরাজুল ইসলাম বলেন, রোগীর নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনেই হাসপাতালে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল। অল্পসংখ্যক লোকজন উপস্থিত ছিলেন। এতে অন্য কোনো রোগীর স্বাস্থ্যসেবায় কোনো ব্যাঘাত ঘটেনি।
আনন্দ সাহার পরিবারের সদস্যরা জানান, আনন্দের শারীরিক অবস্থা কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় চিকিৎসকদের পরামর্শ নিয়েই বিয়ের আয়োজন করা হয়। বিয়ের বিশেষ মুহূর্তটি আফরোজা বেগম জেনারেল হাসপাতালের ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি লাইভ সম্প্রচার করা হয়।
এ সময় স্বজনরা জানান, হাসপাতালে আনন্দের এমন আনন্দ হবে আমরা বুঝতেই পারিনি। আমরা অনেক খুশি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনেক ধন্যবাদ।
বরের চাচাতো ভাই অমি সাহা গতকাল শুক্রবার বলেন, ‘ডিসেম্বরে বড় আয়োজনে বিয়ের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু দুর্ঘটনার কারণে এখন আমাদের প্রথম কাজ আনন্দের চিকিৎসা ও সেবা। তাই পরিবারের সিদ্ধান্তে শুক্রবার রাতে সীমিত পরিসরে তাদের বিয়ে সম্পন্ন করা হয়েছে। নবদম্পতির জন্য সবার কাছে দোয়া চাই।’
এমন ব্যতিক্রমী আয়োজনে চারদিকে তৈরি হয়েছে আলোড়ন। স্থানীয়রা ঘটনাটিকে অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করে নবদম্পতির জন্য শুভকামনা জানিয়েছেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন