শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ১১:৪২ পিএম

স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন মিঠু

রূপালী প্রতিবেদক

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১১, ২০২৫, ১১:৪২ পিএম

স্বাস্থ্য খাতের মাফিয়া হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন মিঠু

  • ২০ বছরের বেশি সময় ধরে জিম্মি করে রেখেছেন দেশের স্বাস্থ্য খাত
  • আমেরিকা, সিংগাপুর, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে বিপুল সম্পদ 
  • কারাগারে মিঠু, রিমান্ড ও জামিন শুনানি ১৮ সেপ্টেম্বর

স্বাস্থ্য খাতে সিন্ডিকেট করে ও প্রভাব খাটিয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে যাওয়া স্বাস্থ্যের মাফিয়া মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠু ছিলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০ বছরের বেশি সময় মিঠু জিম্মি করে রেখেছেন দেশের স্বাস্থ্য খাত। গত ১৫ বছর মিঠুর বিরুদ্ধে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে মালামাল সরবরাহ ও উন্নয়ন কাজের নামে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাও করে দুদক। আওয়ামী সরকারের আশীর্বাদে পরবর্তীতে মামলা থেকে অব্যাহতিও পান মিঠু। অদৃশ্য কারণে তার বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়নি। 

সর্বশেষ, যুক্তরাষ্ট্রে তার ৫শ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ হওয়ার খবর প্রকাশের পর নড়েচড়ে বসে দুদক। পরে গত বছর তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ফের অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি। অবশেষে গত বুধবার রাতে স্বাস্থ্য খাতে ‘সিন্ডিকেট করে অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারে’ জড়িত থাকার অভিযোগে আলোচিত ঠিকাদার মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে দুদকের করা মামলায় গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তারের পর গতকাল বৃহস্পতিবার তাকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

তার পক্ষে জামিনের আবেদন এবং দুদকের করা ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন শুনতে আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করে দিয়েছেন ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ইব্রাহিম মিয়া।

দুদকের নথিপত্রে দেখা গেছে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শুরু করে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় ঔষধাগার, ঢাকা ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল, দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মৌলভীবাজার জেনারেল হাসপাতাল, গোপালগঞ্জ জেনারেল হাসপাতাল ও আইএইচটি সিলেটসহ ১২টি প্রতিষ্ঠানে ঠিকাদারি করার নামে মিঠুর ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ পেয়েছে দুদক।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে এসব প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিতে পুকুরচুরি করেছেন মিঠু। যন্ত্রপাতি সরবরাহ না করেও এর বিপরীতে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। যেসব প্রতিষ্ঠানে যন্ত্রপাতি সরবরাহ করেছেন, সেগুলোও ইউরোপ-আমেরিকার নামিদামি ব্র্যান্ডের নামে ভুয়া স্টিকার লাগানো। কখনোবা নতুন যন্ত্রের বদলে দিয়েছেন রিকন্ডিশন্ড যন্ত্র। ২০১৭ সালে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি রোধে দুদক একটি প্রাতিষ্ঠানিক টিম গঠন করে। ওই সময় মিঠু দুদক থেকে সম্পদবিবরণী দাখিলের নোটিশ প্রাপ্তির পরও দাখিল না করায় তার বিরুদ্ধে বনানী থানায় মামলা করে দুদক।

জানা গেছে, মিঠুর প্রতিষ্ঠান ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের কার্যাদেশ পান। কার্যাদেশপ্রাপ্ত হয়ে মালপত্র সরবরাহ না করে সরকারি প্রতিষ্ঠানের কয়েক হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেন। এই টাকার বড় অংশই বিদেশে পাচার করেন তিনি। ২০০৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইজ এবং টেকনোক্রেট লিমিটেড নামে দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতে প্রায় ৯০ শতাংশ যন্ত্রপাতি সরবরাহ করা হয়।

এ ছাড়া ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়ার জেরে সম্প্রতি দেশজুড়ে আলোচনায় আসা সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের ব্যবসার অংশীদার মিঠু। অভিযোগ আছে, নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলায় কৃষকদের প্রায় ৩০ একর জমি জবরদখল করে ‘নর্থস চিকস রংপুর লিমিটেড’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এতে বেনজীর ও মিঠুর পাশাপাশি জাতীয় দলের ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানেরও অংশীদারত্ব রয়েছে। এ ছাড়া ঠাকুরগাঁওয়ের দৌলতপুর উপজেলায় প্রায় ৩০ একর জমির ওপর ‘নর্থস এগ লিমিটেড’ নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়েছেন মিঠু ও বেনজীর। অভিযোগ আছে, অতীতে দুদকের বিভিন্ন অনুসন্ধান ও মামলা থেকে মিঠুকে রক্ষা করতে বেনজীর আহমেদ সহায়তা করেছেন।

দুদক সূত্র জানায়, মিঠুর রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ও দেশের বাইরে আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল অর্থ পাচার করে অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। 

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির অভিযোগে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুকে রাজধানীর গুলশান এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়কালে স্বাস্থ্য খাতে সংঘটিত অর্থ আত্মসাৎ ও অসংগতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-উত্তর) মোহাম্মদ রবিউল হোসেন ভূঁইয়া গণমাধ্যমকে বলেন, মিঠুর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা রয়েছে। দুদকের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার রাতে তাকে গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে দুদকে হস্তান্তর করা হয়। 

দুদকের তথ্যমতে, মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানে তাকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সংস্থাটির উপপরিচালক মো. সাইদুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন একটি টিম মিঠুকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাকে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে মিঠুকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। আদালতের আদেশে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

দুদকের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, মিঠুকে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে দুপুর ১২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদকালে তিনি সম্পদ অর্জনের বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাকে আরও জিজ্ঞাসাবাদের প্রয়োজন বিধায় আদালতে হাজির করে ১০ দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়। আগামী ১৮ সেপ্টেম্বর মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ওইদিন রিমান্ডের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।  

এদিকে, অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মোতাজ্জেরুল ইসলাম মিঠুর বিরুদ্ধে গতকাল বৃহস্পতিবার মামলা করেছে দুদক। সংস্থাটির উপপরিচালক মা. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে দুদকের ঢাকা জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, ঠিকাদার মিঠু লেক্সিকোন মার্চেন্ডাইস অ্যান্ড টেকনোক্রেটের মালিক। দুদকের অনুসন্ধানে তার স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে ৭৫ কোটি ৮৫ লাখ ৩১ হাজার ৭৩৮ টাকার সম্পদ পাওয়া যায়। এ ছাড়া তার পারিবারিক ব্যয় ৭১ কোটি ৪৫ লাখ ১৪ হাজার ৪৩৪ টাকা। মিঠুর পারিবারিক ব্যয়সহ মোট ১৪৭ কোটি ৩০ লাখ ৪৬ হাজার ১৭২ টাকা অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৭১ কোটি ৪৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭৩৫ টাকা অর্জনের গ্রহণযোগ্য উৎস পাওয়া যায়। বাকি ৭৫ কোটি ৮০ লাখ ৭৭ হাজার ৪৩৭ টাকা অর্জনের গ্রহণযোগ্য কোনো উৎস পাওয়া যায়নি। যা তিনি অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জন করার অপরাধে একটি মামলা করা হয়। 

এদিকে, মিঠুর অভিযোগ অনুসন্ধানকালে ঢাকা মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতের আদেশে তার ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৯১ হাজার ৫০০ টাকার স্থাবর এবং ৫৭ কোটি ৩১ লাখ ৮০ হাজার ২৩৮ টাকা অস্থাবর সম্পদসহ মোট ৭৩ কোটি ৭৪ লাখ ৭১ হাজার ৭৩৮ টাকার সম্পদ ক্রোক ও অবরুদ্ধ করা হয়। একইসঙ্গে আদালতে আদেশে তার বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করে দুদক। 

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে গত ৫ অক্টোবর দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে মিঠুর ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। এ সম্পদের মধ্যে রয়েছে নিউইয়র্কের ব্রংকসে বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। ২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে একটি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছিলেন। ওই দেশে হোটেল-মোটেল ব্যবসারও রয়েছে তার। আটলান্টায় ‘মোটেল সিক্স’ নামে একটি বিলাসবহুল প্রতিষ্ঠানের অন্যতম পরিচালক তিনি। যেখানে তার লগ্নি প্রায় ৭ মিলিয়ন ডলার। নিউইয়র্কের বাঙালি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটসেও মিঠুর দুটি দোকান রয়েছে, যেগুলোর মূল্য এক মিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া ম্যানহাটনে ১৫ মিলিয়ন ডলারে কেনা একটি অফিস রয়েছে মিঠুর। ফ্লোরিডা ও ক্যালিফোর্নিয়ায় তার আরও দুটি অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে, যা মার্কিন সরকার সম্প্রতি জব্দ করেছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

জানা গেছে, ২০১৬ সালে প্রকাশিত পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ঘটনা প্রকাশিত হয়। পানামা পোপারস কেলেঙ্কারিতেও মিঠুর নাম রয়েছে।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!