নীতিমালা ভেঙে ঢাকার ধানমন্ডিতে বিলাসবহুল ফ্ল্যাট বরাদ্দের অভিযোগে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সচিব পদমর্যাদার ১২ কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গতকাল বৃহস্পতিবার দুদক মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেন তলবি নোটিশ পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
দুদকের তথ্যমতে, ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ‘দিনের ভোট রাতে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত’ সচিব পদমর্যাদার ১২ কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করতে শেখ হাসিনার আমলে পরিকল্পিতভাবে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। নিয়ম ভেঙে ধানমন্ডির সরকারি জমিতে বহুতল ভবন নির্মাণ করে দুদক কমিশনার ও সচিবসহ সরকারি শীর্ষপর্যায়ের ১২ কর্মকর্তাকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দেওয়ার অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নামে দুদক। সংস্থাটির সহকারী পরিচালক আল-আমিনের নেতৃত্বে দুই সদস্যের একটি টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছেন। অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে তাদের দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য নোটিশ পাঠানো হয়।
যাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করা হয়েছে তারা হলেন- দুদকের সাবেক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান এবং জহরুল হক। এ ছাড়া রয়েছেন সাবেক সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান, সাবেক সচিব কাদের সরকার, সাবেক সিনিয়র সচিব ড. এম আসলাম আলম, সাবেক সচিব আকতারী মমতাজ, মো. সিরাজুল হক খান, সাবেক চেয়ারম্যান (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ) দ্বিতীয় কোর্ট অব সেটেলমেন্ট মো. মঞ্জুরুল বাছিদ, সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল (সিনিয়র জেলা জজ) সৈয়দ আমিনুল ইসলাম, সাবেক মহাপরিচালক (মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক অধিদপ্তর, ঢাকা) অধ্যাপক নেহাল আহমেদ, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমান এবং এসএম গোলাম ফারুক। নোটিশে তাদের আগামী ১৭, ১৮ ও ২১ সেপ্টেম্বর দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করতে বলা হয়েছে।
দুদকের তথ্যমতে, চলতি বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত সচিব পদমর্যাদার ১২ কর্মকর্তাকে পুরস্কৃত করতে নিয়ম ভেঙে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকায় ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ পায় দুদক। অভিযোগে বলা হয়, ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার ৬/এ নম্বর সড়কের ৬৩ নম্বর প্লটে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ১৪তলা একটি বহুতল ভবন নির্মাণ করে ১২ জন কর্মকর্তাকে ফ্ল্যাট বরাদ্দ দিয়েছে। ওই জমিটি মূলত সরকারের পরিত্যক্ত সম্পত্তি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে জমিটি প্রথমে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং সেখানে ১৪তলা একটি ভবন নির্মাণ শুরু করা হয়। ভবনটিতে দুটি ডুপ্লেক্সসহ মোট ১৮টি ফ্ল্যাট ও দুইতলা গাড়ি পার্কিং রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ (১২টি) সরকারি এবং ৪০ শতাংশ (৬টি) বেসরকারি কোটায় বরাদ্দযোগ্য।
দুদক অভিযোগটি পেয়ে চলতি বছরের ৮ মে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানকালে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। পরে এনফোর্সমেন্ট টিম অভিযানকালে প্রাপ্ত তথ্য ও নথিপত্র যাচাই শেষে কমিশনে পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন দাখিল করে। সেই প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। অভিযোগটি অনুসন্ধান করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য গত ৩০ জুন দুদকের সহকারী পরিচালক আল-আমিন ও উপসহকারী পরিচালক নাহিদ ইমরানের সমন্বয়ে একটি টিম গঠন করা হয়। পাশাপাশি জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষও বিষয়টি খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করে।
জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধান শুরু হলে চলতি বছরের ৮ জুলাই সরকারি কর্মকর্তাদের নামে ফ্ল্যাট বরাদ্দ বাতিল করা হয়। দুদকের এনফোর্সমেন্ট টিমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের ২৭৪তম বোর্ড সভায় এসব ফ্ল্যাটের বরাদ্দ বাতিল করা হয়।
যাদের নামে প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে ডুপ্লেক্স ফ্ল্যাট দুটি বরাদ্দ পান সাবেক অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ও দুদকের সাবেক কমিশনার মো. জহুরুল হক (ফ্ল্যাটের আয়তন ৪১০৫ বর্গফুট) এবং সাবেক সিনিয়র সচিব ও দুদকের সাবেক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান (ফ্ল্যাটের আয়তন ৪৩০৮ বর্গফুট) নামে। আর বাকি ১০টি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়- সাবেক সিনিয়র সচিব মো. ইউনুসুর রহমান (ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫ বর্গফুট), সাবেক সচিব এম এ কাদের সরকার (ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯ বর্গফুট), সাবেক সিনিয়র সচিব আসলাম আলম (ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯ বর্গফুট), সাবেক সচিব আকতারী মমতাজ (ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯ বর্গফুট), সাবেক সচিব মো. সিরাজুল হক খান (ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫ বর্গফুট), সাবেক সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ (ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫ বর্গফুট), সাবেক রেজিস্ট্রার জেনারেল ও সাবেক সিনিয়র জেলা জজ সৈয়দ আমিনুল ইসলাম (ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯ বর্গফুট), মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ (ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯ বর্গফুট), সাবেক সিনিয়র সচিব ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান (ফ্ল্যাটের আয়তন ২৩১৫ বর্গফুট) এবং সাবেক সিনিয়র সচিব এস এম গোলাম ফারুককে (ফ্ল্যাটের আয়তন ২০৪৯ বর্গফুট)।