ঢাকা শুক্রবার, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ব্যক্তিস্বার্থে নয়, রাজনীতি চলুক জনস্বার্থের পথে   

ড. ফরিদুল আলম 
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১২, ২০২৫, ০১:১৩ এএম

রাজনীতি ও কূটনীতি বিশ্লেষক। অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙেছিলাম, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হলেও আমরা আমাদের কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র বিনির্মাণের দিকে মনোযোগী হতে পারিনি। এর দায় সম্পূর্ণভাবে আমাদের রাজনীতিবিদদের। গত বছর ছাত্র-জনতার স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মধ্যদিয়ে সরকার পতনের পর একটি নতুন বন্দোবস্তের কথা বলা হলেও অনেক মৌলিক বিষয়গুলো উপেক্ষিত রয়ে গেছে। তা ছাড়া দেশ গঠন এবং জনগণের জন্য যা কিছু প্রয়োজন, এর সবকিছু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পন্ন হবে এটাই সর্বজনস্বীকৃত। আমাদের আজ নির্ভর করতে হচ্ছে একটি অনির্বাচিত অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর, যারা রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কারিগর হিসেবে দাবি করছে। এ সবকিছুই আমাদের রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা। 

একবার নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় যেতে পারলে অপরাপর রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর চড়াও হওয়া, বিরাজনীতিকরণের চেষ্টা, এ সবকিছুই দেশের অভ্যন্তরে একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বারবার। রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের কাছে প্রত্যাশা থাকবে, তারা নিজেরা আদর্শভিত্তিক রাজনীতি করবেন এবং অপরাপর দলগুলোর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবেন। এটাও মনে রাখতে হবে যে, একটি সুষ্ঠু রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং নির্বাচনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে দেশের রাজনীতির গুণগত মান অনেক বাড়বে এবং দিন শেষে এর সফলভোগী হবে আপামর জনগণ। তা না করতে পারলে রাজনীতির শ্রী ফিরবে না। ব্যবস্থা ভালো হলে অবস্থা ভালো হতে বাধ্য, এটাই বাস্তবতা।  

সময়ের গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে, নির্বাচনি ব্যবস্থাকে শতভাগ সরকারের প্রভাববলয়ের বাইরে রাখতে হবে। বিগত সময়ে দেশে যেভাবে নির্বাচনের নামে প্রহসন করা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে একটি দলের গৌরোবজ্জ্বল ইতিহাসে যে কালিমা লেপন হয়েছে, এর থেকে বের হওয়া কঠিন। নির্বাচনি ব্যবস্থায় সরকারের এই প্রভাবের নামে যারা নির্বাচন কার্য পরিচালনার দায়িত্বে থাকেন, তারাও সমান বিতর্কিত হন। আমাদের মনে রাখতে হবে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার সরকারি চেষ্টাকে জনগণ কখনো মেনে নেয়নি। কিন্তু এর থেকে কোনো দলই শিক্ষা নেয়নি। ভারতের মতো এত বড় একটি দেশ যদি নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকে সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে পারে, তাহলে আমরা কেন পারব না। এমনকি আমাদের প্রতিবেশী মিয়ানমার এবং পাকিস্তানের মতো দেশ, যেখানে গণতন্ত্র সেই অর্থে কার্যকরভাবে গড়ে উঠতে পারেনি, সেখানেও নির্বাচনি ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের মতো এতটা বিতর্ক হয় না। আমার মনে হয় বিশ্বের যে কয়েকটি দেশে নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক রয়েছে, এর মধ্যে বাংলাদেশ একটি রাষ্ট্র। রাজনৈতিক দলগুলো এখানে  ক্ষমতাকে আকড়ে রাখতে গিয়ে গোটা নির্বাচনি ব্যবস্থাকেই বিতর্কিত করেছে। আর তাই আমাদের দেশে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা আসছে। এক অর্থে এটা খুবই লজ্জার। 

যে প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল, তাদের সেই সময় থেকে পরবর্তী ৩ মাসের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা করা দরকার ছিল। একটি অন্তর্বর্তী সরকারের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধোনী এবং রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্রের ব্যাপক পরিবর্তন কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়। গণপরিষদ নির্বাচনের বিষয়টি দুএকটি রাজনৈতিক দল বলছে, অপরাপর দলগুলো এটিকে সমর্থন করছে না। রাষ্ট্রের কাঠামোর যদি ব্যাপক পরিবর্তন করতে হয়, তাহলে তো সব রাজনৈতিক দলগুলো মিলে আগে অন্তর্বর্তী সরকারকে নির্বাচন আয়োজনের জন্য চাপ দেওয়া উচিত। এ বিষয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে পরবর্তী সরকারের সময়ে আইনানুগভাবে গণপরিষদ বা সংবিধানের প্রত্যাশিত পরিবর্তনগুলো আনা সম্ভত। এভাবে একটি অনির্বাচিত সরকারের মেয়াদকে দীর্ঘায়িত করার মানে এটাই বুঝতে হবে যে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থের গ-ি থেকে এখনো বের হতে পারছে না, যা ভবিষ্যতের কাক্সিক্ষত সুন্দর রাজনৈতিক বন্দোবস্তের জন্য একটি বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে থেকে যাবে।

জাতীয় নির্বাচনকে প্রশ্নমুক্ত করার সবচেয়ে বড় শর্ত হচ্ছে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এখানে যে বিষয়টি ইতোমধ্যে নিষ্পত্তি হয়ে গেছে, তা হলো বিগত বছরগুলোতে যারা দীর্ঘ সময় ধরে দেশ শাসন করেছে তাদের নির্বাচন থেকে বিরত রাখা। এর মধ্য দিয়ে বিগত সরকার যেভাবে নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিয়েছিল, এর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় সেটাই বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা যদি জনগণের শক্তির ওপর আস্থা রাখি, তাহলে নির্বাচনে অংশ নিয়ে কারা নির্বাচিত হয়ে আসবে, সেটা তাদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া উচিত। বিদেশি পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন, সেটা আমাদের বিবেচনার বিষয় হওয়া উচিত নয়। বরং আমরা একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথে এগুতে পারলাম কি না সেটা আমাদেরই মূল্যায়ন করতে হবে। দেশটা তো আমাদের। এটাও মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে ঘন ঘন রাজনৈতিক ঋতু পরিবর্তন ঘটে। আমাদের আজকের কোনো কর্ম যা বিতর্কিত মনে হতে পারে, এর জন্য একসময় না একসময় এর সঙ্গে সম্পৃক্তদের জবাবদিহিতার আওতায় আসতে হবে। 

প্রশ্ন হচ্ছে , গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার দায় কার? দেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার জন্য একক দায় রাজনৈতিক দলগুলোর। আমার মাথায় আসে না, যে রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্ন সময় দেশ পরিচালনা করেছে, তারা তো নিজেদের দলগত পরিসরেই গণতন্ত্রের চর্চা করে না। পারিবারিক ধারার রাজনীতি, সেই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানদের দেবতুল্য করে তোলা, এ সবকিছুর দায় যারা রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছেন তাদেরই  নিতে হবে। আমরা গভীরভাবে একটি বিষয় খেয়াল করেছি যে, নির্বাচিত হওয়ার আগে দলগুলোর যে প্রতিশ্রুতি থাকে ভোটারদের কাছে, নির্বাচিত হওয়ার পরে তারা সবকিছুই বেমালুম ভুলে যায়। প্রজাতান্ত্রিকতার পরিবর্তে এ ধরনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে কার্যত এক ধরনের নব্য রাজতান্ত্রিক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সুদৃঢ়করণের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি রাষ্ট্রের সকল প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক করে তুলতে হবে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের দিকে লক্ষ্য করলে আমরা দেখব যে অনেক যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কংগ্রেসের নেতৃত্ব নিতে রাহুল গান্ধী তার অপারগতার কথা জানিয়েছেন, অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও সোনিয়া গান্ধী বা রাহুল গান্ধী দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারকদের গভীর বোধোদয়ের সময় এসেছে, তারা কতটুকু জনস্বার্থে আর কতটুকু ব্যক্তিস্বার্থে রাজনীতি করছেন।

মনে রাখা বাঞ্ছনীয়, আমরা আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ থেকে অনেক দূরে আছি। বিপ্লব বা আন্দোলন করে একটি সরকারকে হটিয়ে আমরা যখন এটা দেখি, রাজনৈতিক দলগুলো কোনো না কোনোভাবে ক্ষমতায় যেতে চায় বা ক্ষমতারবলয়ের কাছাকাছি থাকতে চায়। একাত্তর থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক পট পরিক্রমায় যারা গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, তাদের জন্য তখন খুব কষ্ট হয়। আমাদের দেশের সামর্থ্য বিবেচনায় আমার স্বপ্নগুলো খুব বড় নয়। আমাদের  চাওয়া হচ্ছে,  রাজনৈতিক দলগুলো জাতীয় স্বার্থে একত্রে থাকুক, দেশ দুর্নীতিমুক্ত থাকুক, একটি সুন্দর নির্বাচনি ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হোক, যোগ্যদের যথার্থ মূল্যায়ন হোক, এটুকুই। এর জন্য সর্বাগ্রে জরুরি রাজনীতির গুণগত মান পরিবর্তন।

ড. ফরিদুল আলম