ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে ১১টি অনিয়মের অভিযোগ তুলেছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেল। এসব অভিযোগের মধ্যে রয়েছে; প্রশাসনের পক্ষপাতিত্ব, নির্বাচনি আচরণবিধি সম্পর্কে অধিকাংশ পোলিং অফিসারের ন্যূনতম ধারণা না থাকা, ভোটারদের নির্দিষ্ট প্যানেলের পক্ষে ভোট দেওয়া ব্যালট পেপার সরবরাহ, ব্যালট পেপারে ক্রমিক নম্বর না থাকা ও ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় ত্রুটি।
গতকাল সোমবার বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের পক্ষ থেকে এই অভিযোগগুলো জানানো হয়।
গত ৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’ ভিপি, জিএস ও এজিএসসহ ২৮টি পদের মধ্যে ২৩টিতেই জিতেছে। অন্যদিকে ডাকসুর কোনো পদে জিততে পারেনি ছাত্রদল।
ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের সাধারণ সম্পাদক (জিএস) প্রার্থী শেখ তানভীর বারী হামীম গতকালের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে একটি বিশেষ মহল রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে তাঁদের (ছাত্রদল) শিক্ষার্থীদের নেতিবাচকভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা চালিয়ে আসছে। ডাকসুর তপশিল ঘোষণার পরই তাঁরা নানা অনিয়ম দেখেন। নিয়ম মেনে তারা অনিয়মের বিষয়ে অভিযোগ জানান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সে সবের সমাধান দিতে ব্যর্থ হয়।
সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল-সমর্থিত প্যানেলের সহসভাপতি (ভিপি) প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান বলেন, যতক্ষণ না পর্যন্ত নির্বাচনের সুষ্ঠুতা নিয়ে প্রশাসন নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁদের (ছাত্রদল) জায়গা থেকে নির্বাচনকে বৈধতা দেওয়ার সুযোগ নেই। এ সময় তিনি ১১টি অনিয়মের অভিযোগ তুলে ধরেন। অভিযোগগুলো হলো-
১. ভোটারকে নির্দিষ্ট প্যানেলের পক্ষে ভোট দেওয়া ব্যালট পেপার সরবরাহ, ভোটার উপস্থিত হওয়ার আগেই ভোটার তালিকায় উপস্থিতির স্বাক্ষর দিয়ে দেওয়াসহ নানা জালিয়াতির সংবাদ নির্বাচন চলাকালে গণমাধ্যমে এসেছে। বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ও ভোট প্রদানের হারে অসামঞ্জস্যতা পরিলক্ষিত হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের প্রার্থীরাসহ অধিকাংশ প্যানেল ও একাধিক স্বতন্ত্র প্রার্থী ভোটার উপস্থিতির তালিকা ও ভোটকেন্দ্রের সিসিটিভি ফুটেজ চেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বরাবর আবেদন করেন। ঢাবি প্রশাসন সে বিষয়ে বারবার আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে কালক্ষেপণ করছে।
২. ২০১৯ সালের ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ব্যালট পেপারে ক্রমিক নম্বর ছিল না। ফলে ছাত্রলীগ নীরবে ভোট কারচুপির সুযোগ তৈরি করতে পেরেছিল। এবারের নির্বাচনে ব্যবহৃত ব্যালট পেপারেও কোনো ক্রমিক নম্বর ছিল না। এ ছাড়া ছাপানো ব্যালট পেপারের সংখ্যা, ভোটকেন্দ্রে সরবরাহকৃত-ব্যবহৃত-বাতিল হওয়া ব্যালট পেপারের সংখ্যা এবং ভোট গ্রহণ শেষে ফেরতকৃত ব্যালট পেপারের সংখ্যা কোথাও প্রকাশ করা হয়নি। বারবার জানতে চাওয়ার পরেও এ-সংক্রান্ত তথ্যকেন্দ্রে দায়িত্বরত পোলিং এজেন্টদের জানানো হয়নি। ফল প্রকাশের পর উল্লিখিত অভিযোগগুলো নিয়মানুযায়ী চিফ রিটার্নিং অফিসার বরাবর দায়ের করতে গেলে তিনি ঢাবি প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। পরবর্তী সময়ে ব্যালট পেপারসংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক প্রার্থী ও পোলিং এজেন্ট যথাযথ প্রক্রিয়ানুসারে অভিযোগ দায়ের করে। কিন্তু ঢাবি প্রশাসন তদন্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করে নানা অজুহাতে কালক্ষেপণ করছে।
৩. নির্বাচনে ব্যবহৃত ব্যালট পেপার কোন প্রেস থেকে ছাপানো হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। অনিরাপদ ছাপাখানা থেকে ফাঁস হওয়া নকল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট কারচুপির অভিযোগ ইতিমধ্যে এসেছে। ৭ সেপ্টেম্বর নীলক্ষেতের গাউসুল আজম মার্কেটের একটি ছাপাখানায় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের বিপুলসংখ্যক ব্যালট পেপার অরক্ষিত অবস্থায় পাওয়া যায়, যেখানে ঢাবি প্রশাসনের কোনো নজরদারি ছিল না বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
৪. ডাকসু নির্বাচনের চার দিন পর ১৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিজ্ঞপ্তি অনুসারে ভোট গণনা মেশিনসহ সফটওয়্যার নির্ভুলতা-বিশ্বাসযোগ্যতা যাচাইয়ের সময় নির্দিষ্ট কয়েকজন শিক্ষক-টেকনিশিয়ান উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু ভোটার ও প্রার্থীদের এ বিষয়ে অবহিত করা হয়নি। ভোট গণনার বিষয়ে ইতিমধ্যে নানা অভিযোগ ও বিতর্ক সামনে এসেছে। কিন্তু একটি কার্যকর গণনা প্রক্রিয়া নিশ্চিত করা গেলে এ ধরনের বিতর্ক তৈরি হতো না।
৫. প্রত্যেক প্রার্থীর কাছ থেকে প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য একজন করে পোলিং এজেন্ট নেওয়ার বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ভোটের আগের দিন মধ্যরাতে পোলিং এজেন্টদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। তালিকায় প্রার্থীদের প্রস্তাবিত বিভিন্ন কেন্দ্রের পোলিং এজেন্টদের বাদ দেওয়া হয়। কোন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পোলিং এজেন্টদের বাছাই করা হয়েছে, তা প্রকাশ করা হয়নি।
৬. ভোট গ্রহণের আগে পোলিং এজেন্টদের আইডি কার্ড সরবরাহ করার কথা ছিল। কিন্তু তা যথাসময়ে সরবরাহ করা হয়নি। যে কারণে অনেক পোলিং এজেন্ট যথাসময়ে উপস্থিত হয়েও ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করতে পারেননি। অনেক ভোটকেন্দ্রে পোলিং এজেন্টের অনুপস্থিতিতে পক্ষপাতদুষ্ট অবস্থায় ভোট গ্রহণ শুরু হয়।
৭. একটি নির্দিষ্ট প্যানেল বাদে সব প্রার্থী ও প্যানেলকে জানানো হয়, ৮টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ হবে। কিন্তু ভোটের দিন দেখা যায়, ৮টি ভোটিং এরিয়ায় মোট ১৮টি কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হচ্ছে। যে কারণে নির্দিষ্ট প্যানেলটি ছাড়া আর কোনো প্রার্থী বা প্যানেল ১৮টি কেন্দ্র অনুসারে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি।
৮. ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করে পোলিং অফিসার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, সে বিষয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে। চিফ রিটার্নিং অফিসার কর্তৃক পোলিং অফিসার নিয়োগ করার কথা ছিল। কিন্তু তাঁদের ঢাবি প্রশাসন কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে তিনি (চিফ রিটার্নিং অফিসার) জানিয়েছেন। নির্বাচনি আচরণবিধি সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ছিল না অধিকাংশ পোলিং অফিসারের। ফলে নির্বাচনি আচরণবিধি সম্পর্কে তাঁরা সাংবাদিকদের ভুল তথ্য দিয়েছেন। তাঁরা প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের ভুয়া অভিযোগ তুলে নির্বাচনকে প্রভাবিত করেছেন।
৯. নিরাপত্তাসহ ভোটসংশ্লিষ্ট দায়িত্বে থাকা কতিপয় অতি উৎসাহী বিএনসিসি, রোভার স্কাউট ও গার্ল গাইডস সদস্যের ভূমিকা ইতিমধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। নির্বাচনের দিন ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা কতিপয় বিএনসিসি, রোভার স্কাউট ও গার্ল গাইডস সদস্যের সহায়তায় একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ক্যাম্পাসে অবাধে প্রবেশের সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে একাধিক অভিযোগ এসেছে। একাধিক বহিরাগত শিবিরকর্মীকে শিক্ষার্থীরা হাতেনাতে ধরে প্রক্টর অফিসে সোপর্দ করেছে।
১০. ভোট গণনার সময়ে পোলিং এজেন্টদের কার্যত নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করতে বাধ্য করা হয়েছে। ভোট গণনা প্রক্রিয়ার সঙ্গে পোলিং এজেন্টদের যথাযথভাবে যুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া গণনা প্রক্রিয়ায় ত্রুটি ছিল। এর প্রতিবাদে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সব পোলিং এজেন্টসহ অধিকাংশ প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট রেজাল্ট শিটে স্বাক্ষর না করে ভোটকেন্দ্র ত্যাগ করেন।
১১. ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে অস্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ব্যবহার করায় বিভিন্ন অভিযোগ ও বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তা ছাড়া অধিকাংশ বুথে নির্বাচনের দিন বেলা ১১টা ৩০ মিনিটের পর থেকে মার্কারপেন ছিল না। ফলে ভোটারদের বলপেন দিয়ে ব্যালট পেপারে ক্রস চিহ্ন দিতে হয়েছে। বলপেনে ক্রস চিহ্ন দেওয়া ভোটগুলো ওএমআর মেশিন সঠিকভাবে রিড করতে পারেনি। তাই অনেক ভোট গণনা করা হয়নি বলে পোলিং এজেন্টরা লক্ষ করেছেন। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পরের ভোটগুলোতে বলপেন ব্যবহার করে পরিকল্পিতভাবে ভোট নষ্ট করার হীন চেষ্টা ছিল কি না, তা নিয়ে অধিকাংশ প্রার্থীর মনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া ভোটার চিহ্নিত করার জন্য আঙুলে যে মার্কারের কালি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি অস্থায়ী কালি হওয়ায় একই ব্যক্তি একাধিক ভোট দিয়েছেন কি না, সে বিষয়ে শিক্ষার্থীদের মনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
আবিদুল ইসলাম খান সংবাদ সম্মেলনে আরও বলেন, আইন ও বিধি অনুসারে এই অনিয়ম-অসংগতিগুলোর বিষয়ে বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে সমাধানের অনুরোধ করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। বরং ইচ্ছাকৃতভাবে কালক্ষেপণ করেছে। ফলে ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন ২০২৫ ইতিহাসের পাতায় নেতিবাচকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ একটি নির্বাচন হিসেবে ঠাঁই পাওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁরা মনে করেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন