বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে প্রতি বছরই লাখো পর্যটকের সমাগম ঘটে। ঈদ, পূজা, নববর্ষ কিংবা শীতকালÑ যে সময়ই হোক না কেন, এই সৈকত পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকে। কয়েক দশক ধরে দেশের প্রধান পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে কক্সবাজার আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পরিচিতি পেয়েছে। এই সময়গুলোয় হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ, সুভেনিয়র শপ থেকে শুরু করে পরিবহন ব্যবসা জমজমাট হয়ে ওঠে। কিন্তু এই বিপুল অর্থনৈতিক কর্মকা-ের পরও সরকারের রাজস্ব আয় তুলনামূলকভাবে সীমিত। একই সঙ্গে সৈকতের নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও উদ্ধারসেবায় বড় ধরনের ঘাটতি রয়ে গেছে, যা কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে।
এর পরও সাম্প্রতিক প্রক্ষেপণে বলা হচ্ছে, ২০২৩ থেকে ২০২৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশে পর্যটন খাত থেকে আয় বেড়ে বার্ষিক ১ দশমিক ৪ থেকে ১ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাতে পারে। শুধু ২০২২ সালেই পর্যটন খাতে আয় দাঁড়ায় প্রায় ৪১৯ মিলিয়ন ডলার। ২০২৪ সালে এই খাত থেকে সরকার ভ্যাট, কর ও ফি হিসেবে রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার কোটি টাকার ওপরে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজার থেকে যে বিপুল রাজস্ব আয় হয়, তার একটি নির্দিষ্ট অংশ নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও উদ্ধার সেবায় খরচ করলে পর্যটন খাত টেকসই হবে। নতুবা পর্যটকের প্রাণহানি ও নিরাপত্তাহীনতা দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
ভিড়ের চাপ, লাখো মানুষের পদচারণা : গত ঈদের ছুটিতে মাত্র তিন দিনে প্রায় চার লাখ পর্যটক ভিড় জমিয়েছিলেন কক্সবাজারে। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর হিসাবে, এক সপ্তাহে পর্যটনকেন্দ্রিক লেনদেন দাঁড়ায় প্রায় ৪০০ থেকে ৭০০ কোটি টাকা। হোটেল, রেস্তোরাঁ, গেস্টহাউস, পরিবহন ও কেনাকাটায় বিপুল অর্থ ব্যয় হলেও তার সিংহভাগই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের আয়ে থেকে যায়। নগদ লেনদেন বেশি হওয়ায় সরকারের রাজস্ব খাতে প্রকৃত আয় জমা পড়ে না।
গবেষণার তথ্যে দেখা যায়, কক্সবাজারের পর্যটন বাজারের বার্ষিক আকার প্রায় ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ। প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৩৭ লাখ পর্যটক এখানে আসেন, যাদের বিশাল অংশই দেশীয়। আন্তর্জাতিক পর্যটকের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে, তবে এখনো তা মোট পর্যটকের তুলনায় সামান্য।
সরকারের আয় বনাম ব্যবসায়ীদের আয় : পর্যটন থেকে যে বিপুল লেনদেন হয়, তার বড় অংশ ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের পকেটেই থেকে যায়। হোটেল ভাড়া, খাবারদাবার, গাইড সেবা, ফটোগ্রাফি, সুভেনিয়র বিক্রিÑ সব মিলিয়ে লেনদেনের একটি বড় অংশ নগদে সম্পন্ন হয়। ফলে সরকারের আয় সীমিত হয়ে পড়ে। অথচ সরকারকে খরচ বহন করতে হয় সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সৈকত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের মতো খাতে।
আন্তর্জাতিক মানের নিরাপত্তা ও উদ্ধারসেবার ক্ষেত্রে কক্সবাজার এখনো পিছিয়ে। পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড বা আধুনিক উদ্ধারসেবা নেই। চিকিৎসাব্যবস্থাও অনগ্রসর। জরুরি চিকিৎসক কিংবা হেলিকপ্টার-সেবা দূরের কথা, পর্যাপ্ত অ্যাম্বুলেন্স সেবাও নেই। ফলে পর্যটকদের প্রাণ ঝুঁকিতে থাকছে প্রতিনিয়ত।
প্রাণহানির উদ্বেগজনক চিত্র :
২০১২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সি-সেফ লাইফগার্ড কর্মীরা সাগরে ভেসে যাওয়া ৮২৩ জন পর্যটককে উদ্ধার করে প্রাণে বাঁচিয়েছেন। একই সময়ে গুপ্তখাল ও ¯্রােতের টানে অন্তত ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত ১৫ বছরে সুগন্ধা, কলাতলী, সিগাল ও লাবণী পয়েন্টে ডুবে মারা গেছেন ১৩৯ জন পর্যটক। এত প্রাণহানি ঘটলেও সৈকতে এখনো আধুনিক উদ্ধার সরঞ্জাম নেই।
পর্যটকদের উদ্ধার কার্যক্রমে নিয়োজিত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সি-সেফ লাইফগার্ড জানিয়েছে, কক্সবাজার সৈকতের ১২০ কিলোমিটারের মধ্যে কেবল পাঁচ কিলোমিটার এলাকাতেই তাদের কার্যক্রম সীমিত। সেখানে লাখো পর্যটকের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত রয়েছেন মাত্র ২৭ জন লাইফগার্ড। অবশিষ্ট ১১৫ কিলোমিটারে কোনো লাইফগার্ড নেই।
কেন রাজস্ব আয় বাড়ছে না :
সরকারি কর্মকর্তারা মনে করেন, পর্যটন খাত থেকে আয় বাড়াতে হলে হোটেল-মোটেল ও রেস্তোরাঁয় কর-ভ্যাট আদায় জোরদার করতে হবে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা তা এড়িয়ে চলেন। নগদ লেনদেনের প্রাধান্যের ফলে ব্যবসায়ীরা কর-ভ্যাটের হিসাব গোপন রাখেন। পর্যটকদের কাছ থেকে আলাদা কোনো পরিবেশ ফি বা সৈকত চার্জ নেওয়ার ব্যবস্থা এখনো চালু হয়নি।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক মানের অন্যান্য সৈকতে যেখানে পর্যটকদের নিরাপত্তা ও চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত থাকে, সেখানে কক্সবাজারে এখনো মৌলিক সেবার অভাব রয়ে গেছে। এতে পর্যটকদের আস্থা কমে যাচ্ছে এবং দীর্ঘ মেয়াদে কক্সবাজারের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে।
কক্সবাজার বাংলাদেশের পর্যটন খাতের প্রাণকেন্দ্র। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত ঘিরে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি লাখো পর্যটক ভিড় জমান। সরকারি হিসাবে, শুধু ২০২৪ সালে প্রায় ৫২ লাখ পর্যটক কক্সবাজারে ভ্রমণ করেছেন। এ থেকে সরকার বিপুল পরিমাণ ভ্যাট, কর ও ফি হিসেবে রাজস্ব পেয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু এত রাজস্ব আয়ের পরও সৈকতের নিরাপত্তা, উদ্ধার কার্যক্রম ও পর্যটকদের স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ পর্যটকদের। তবে সরকার তার কাক্সিক্ষত রাজস্ব পাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি।
বিশেষজ্ঞ ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য :
বাংলাদেশ পর্যটন করপোরেশনের সাবেক চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান খান কবির বলেন, কক্সবাজার সৈকতে বিপুল রাজস্ব আয় হচ্ছে, অথচ সমপরিমাণ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেই। সমুদ্রসৈকতের নিরাপত্তা যদি আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করা যায়, তবে শুধু পর্যটন নয়, বৈদেশিক বিনিয়োগও বাড়বে।
পর্যটন গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি বিভাগের শিক্ষক ড. ফরিদ উদ্দিন মত দেন, প্রতি বছর সরকারের বরাদ্দ যে অঙ্কে দেওয়া হয়, তা স্থানীয় প্রশাসন ও জরুরি সেবার তুলনায় অপ্রতুল। এখানে লাইফগার্ড, ডুবুরি, দ্রুত চিকিৎসাসেবাÑ এসব বাড়াতে হলে আলাদা ‘সৈকত নিরাপত্তা বাজেট’ থাকতে হবে।
পরিবেশবিষয়ক সংগঠন ‘ধরা’র সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, সৈকতে স্রোতের টানে বা গুপ্তখালে ডুবে মৃত্যু এখন নিত্যদিনের ঘটনা। অথচ উদ্ধারকাজে নেই হেলিকপ্টার, নেই পর্যাপ্ত ডুবুরি। ১৫ বছরে ১৩৯ জনের মৃত্যু ঘটেছে। সরকার যদি বার্ষিক রাজস্ব আয়ের সামান্য অংশও নিরাপত্তায় ব্যয় করত, এই প্রাণহানি কমে যেত।
অন্যদিকে স্থানীয় হোটেল-মোটেল মালিক সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা পর্যটক আনার চেষ্টা করি, কিন্তু দুর্ঘটনার খবরে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে আসেন না। এতে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাই সরকারের উচিত সৈকতের নিরাপত্তায় বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া এবং স্থানীয়দেরও সম্পৃক্ত করা।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকার প্রতি বছর সৈকত উন্নয়ন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতায় বরাদ্দ দেয়, কিন্তু উদ্ধারকাজের মতো ব্যয়বহুল সেবায় নির্দিষ্ট বরাদ্দ নেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আলাদা বরাদ্দের দাবি জানাচ্ছি।
করণীয় :
বিশেষজ্ঞদের মতে, কক্সবাজারের মতো আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্রকে টেকসই করতে হলে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যÑ পর্যাপ্তসংখ্যক প্রশিক্ষিত লাইফগার্ড ও ডুবুরি নিয়োগ। জরুরি চিকিৎসা সেবা, চিকিৎসক ও অ্যাম্বুলেন্স সুবিধা নিশ্চিতকরণ। ডিজিটাল পেমেন্ট বাধ্যতামূলক করে ভ্যাট ও কর আদায় জোরদার। সৈকত ব্যবহার বাবদ পরিবেশ ফি চালু। এবং পর্যটক নিবন্ধন ও ই-রসিদ ব্যবস্থা প্রবর্তন। তারা মনে করেন, এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা গেলে পর্যটকদের প্রাণনাশের ঝুঁকি হ্রাস পাবে, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে এবং কক্সবাজার সত্যিকার অর্থেই আন্তর্জাতিক মানের নিরাপদ পর্যটনকেন্দ্রে পরিণত হবে।