অনেকটা গোপনেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আগস্ট বিপ্লবের পর ঘটে গেছে চর দখলের মতো অদ্ভুত ঘটনা। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন বিএমইটি (জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো) দখল করে নিয়েছে একই মন্ত্রণালয়ের স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কল্যাণ বোর্ড। রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, হাতেগোনা কয়েকজন রেখে বিএমইটির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে জবরদস্তি বের করে দিয়ে পুরো বিএমইটির কর্তৃত্ব নিয়ে নিয়েছেন কল্যাণ বোর্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেখানকার সব জনবল বোর্ডের। পিয়ন, গাড়িচালক এবং আউটসোর্সিংয়ের ১০৯ কর্মচারী এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন শাহজালাল। পুরো প্রক্রিয়ার নেতৃত্ব দিচ্ছেন কল্যাণ বোর্ডের উপপরিচালক শওকত হোসেন এবং বিএমইটির পরিচালক (অর্থ) মাসুদ রানা।
পতিত আওয়ামী লীগের দোসর পরিচালক মাসুদ রানা ইতিপূর্বে উপপরিচালক ও সহকারী পরিচালকদের বদলির নামে বাণিজ্য করেছেনÑ এ কথা চাউর হলে ব্যাপক সমালোচনার মুখে তার সেই ক্ষমতা কেড়ে নেয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। এখন বদলি হয় সরাসরি মন্ত্রণালয়ের আদেশে। কিন্তু অন্য কর্মচারীদের বদলির এখতিয়ার এখনো তার। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সব বিধি লঙ্ঘন করে তিনি বিএমইটির সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেনকে তার নিজ জেলা টাঙ্গাইলে পোস্টিং দেন। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত টাঙ্গাইলে থাকার পর আনোয়ারকে মাঝে একবার অন্য জেলায় ঘুরিয়ে এনে আবার টাঙ্গাইলে পোস্টিং দেওয়া হয়। এই সহকারী পরিচালকের বিরুদ্ধে অন্তহীন অভিযোগ।
তার বিরুদ্ধে ফিঙ্গার বাণিজ্য, পিডিও সনদ বাণিজ্য এবং পাসপোর্ট বাণিজ্যের মতো অভিযোগ উঠলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ভুক্তভোগীদের গণশুনানিতে ডাকে। তাদের বক্তব্য শোনার পর আনোয়ারকে সতর্ক করে দেয় দুদক। এত কিছুর পরও টাঙ্গাইল ছাড়েননি তিনি। টাঙ্গাইলে এত মধু! কর্তৃপক্ষও নির্বিকার। তার খুঁটি হিসেবে পরিচালক মাসুদ রানার নাম লোকজনের মুখে মুখে। এদিকে, সহকারী পরিচালক আনোয়ারের ‘দক্ষিণ হস্ত’ হিসেবে পরিচিত জরিপ কর্মকর্তা কামরুন্নাহার ১৫ বছর ধরে টাঙ্গাইলে কর্মরত থাকলেও রহস্যজনক কারণে তাকে বদলি করা হচ্ছে না।
অফিসের পাশে তার ছেলের কম্পিউটারের দোকান। ছেলের মাধ্যমে ফিঙ্গার, পিডিও সনদ, পিপি এবং এনআইডি সংশোধন বাবদ জনপ্রতি ২ হাজার টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। শুধু অবৈধ পন্থায় সহকারী পরিচালক আনোয়ার হোসেনের প্রতিদিনের নিট ইনকাম প্রায় ২ লাখ টাকার মতো। সেই হিসাবে মাসে তিনি প্রায় অর্ধকোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে শোনা যায়। গণশুনানিতে দুদক সতর্ক করার পরও তাকে নিজ জেলা টাঙ্গাইল থেকে বদলি করা হয় না। তিনি টাঙ্গাইলের এক প্রভাবশালী বিএনপি নেতার নাম ভাঙিয়ে চলছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে। ওই নেতার সঙ্গে নাকি তিনি ফটোসেশনও করেছেন। এই ফটোসেশনকে তিনি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন। এই সহকারী পরিচালকের বাড়ি টাঙ্গাইলের সখীপুরে।
ওদিকে শাহজালাল বিমানবন্দরের কল্যাণ বোর্ডের ইনচার্জ কম্পিউটার অপারেটর থেকে সহকারী পরচালক হিসেবে পদোন্নতিপ্রাপ্ত শওকত হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ উপ-সহকারী পরিচালকের সহায়তায় গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের উদোগে চলছে জমজমাট মানবপাচার। এই সিন্ডিকেটে রয়েছে কয়েকজন কম্পিউটার অপারেটর ও পিয়ন সাইফুল ইসলাম। সিন্ডিকেট সদস্য এই পিয়ন সাইফুল ১৫ স্পাঞ্চ করে বুকে ঝুলিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবলীলায় মানবপাচার করছে বলে চাউর আছে। ইমিগ্রেশন পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তার পরামর্শে বুকে বিএমইটি কার্ড স্পাঞ্চ করে ঝুলিয়ে দিলে বিমানে ওঠার আগ পর্যন্ত তাদের আর জবাবদিহি করতে হয় না। ফলে এসব লোক সহজেই বিমানে উঠে পাচার হয়ে যাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। এর বিনিময়ে এই সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রতিদিন হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এদের গতিবিধি নজরদারিতে রয়েছে বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ইতিপূর্বে বিমানবন্দরে মানবপাচারের অভিযোগে এক উপসহকারী পরিচালক চাকরিচ্যুত হন। পরে মামলা করে চাকরি ফিরে পেলে আবার তাকে বিমানবন্দরেই পোস্টিং দেওয়া হয়।
অনুসন্ধানে এই মানবপাচার সিন্ডিকেটের কয়েকজনের নাম রূপালী বাংলাদেশের হাতে এসেছে। তারা হলেনÑ উপ-সহকারী পরিচালক মোশারফ হোসেন, কামরুল ইসলাম, আশরাফুল ইসলাম, শহিদুল ইসলাম, কম্পিউটার অপারেটর বদিউজ্জামান, নাজমুল হোসেন এবং অফিস সহায়ক সাইফুল ইসলাম। তাদের মধ্যে মানবপাচারের অভিযোগে উপসহকারী পরিচালক মোশারফ চাকরিচ্যুত হন। পরে মামলা করে চাকরি ফিরে পেলে আবারও তাকে বিমানবন্দরে পোস্টিং দেওয়া হয়। তার সঙ্গে একই পালায় দায়িত্ব পালন করেন বিএমইটির শামসুন্নাহার। শামসুন্নাহারের মূল পোস্টিং বগুড়া হলেও অজানা কারণে তাকে বিমানবন্দরে সংযুক্ত করে রাখা হয়েছে। গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে উপসহকারী পরিচালক আশরাফকে বিমানবন্দর থেকে ২০১৯ সালে বদলি করা হলেও তদবির করে আবার তিনি বিমানবন্দরে পোস্টিং নেন এবং যথারীতি মানবপাচারে জড়িয়ে পড়েন বলে গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পারে।
এ বিষয়ে কোনো বক্তব্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করে কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন) ইমরান আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমি উপসচিব মর্যাদার ছোট কর্মচারী, আমার এ বিষয়ে কথা বলার কোনো এখতিয়ার নেই। আপনি মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলুন।’ অন্যদিকে বিএমইটি’র পরিচালক (প্রশাসন) মাসুদ রানার বক্তব্য জানতে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন কেটে দেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন