চুয়াডাঙ্গার দর্শনা সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান জিহাদ। ছেলেবেলা থেকেই রোবটের প্রতি কৌতূহল ছিল তার। স্বপ্নবাজ এই তরুণের স্বপ্ন ছিল রোবটিক্সের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নতুন কিছু সৃষ্টি করা। জাহিদের সেই স্বপ্ন রূপ নিয়েছে বাস্তবে। নিজের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে নানা প্রতিকূলতায়ও হাল ছাড়েননি জিহাদ। তার উদ্ভাবনী ‘হেক্সাগার্ড রোভার’ দেশের সীমানা পেরিয়ে প্রশংসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
বোমা শনাক্তকরণ ও নিষ্ক্রিয়করণে সহায়তা, অগ্নি শনাক্তকরণ ও নির্বাপণ, বন্যপ্রাণী নিয়ন্ত্রণ ও উদ্ধার কার্যক্রম, সীমান্তে নজরদারিসহ বিভিন্ন সামরিক মিশন পরিচালনায় সক্ষম জিহাদের তৈরি এই রোভার রোবট।
সম্প্রতি মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে সেগি ইউনিভার্সিটিতে আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ইনোভেশন কমপিটিশন অ্যান্ড এক্সিবিশন (ওয়াইস) ২০২৫ প্রতিযোগিতায় প্রদর্শন করা হয় ‘হেক্সাগার্ড রোভার’; যা ব্যাপক প্রশংসিত হয়। সেখান থেকে জিহাদ স্বর্ণপদক এনে দিয়েছেন বাংলাদেশকে।
এর আগে গত বছর জিহাদের উদ্ভাবনী ‘ট্রেন সিকিউরিটি সিস্টেম’ উপজেলা ও জেলার গ-ি পেরিয়ে ব্যাপক সাড়া ফেলে জাতীয় পর্যায়ে। রোবোটিক্স নিয়ে ব্যাপক গবেষণার জন্য জিহাদ প্রতিষ্ঠা করেন চুয়াডাঙ্গা সায়েন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স ক্লাব। সেখানে প্রায় এক বছর ধরে নিরলস পরিশ্রম করে তৈরি করেন ‘হেক্সাগার্ড রোভার’।
জানতে চাইলে জাহিদ হাসান জিহাদ বলেন, অগ্নিকা-ে উদ্ধার থেকে সামরিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এই রোভার। এই রোবটে রয়েছে ১৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপ সহ্য করার ক্ষমতা, স্টেইনলেস স্টিল বডি, ধোঁয়া ভেদকারী ভি৩৮ প্রো জিরো ক্যামেরা ও এমকিউ সিরিজ গ্যাস সেন্সর। তাই ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা যেখানে পৌঁছাতে অক্ষম সেখানে এই রোবট প্রাথমিক পর্যায়ে পানি বা ফোম ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ এবং আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধার করতে সক্ষম হবে। বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ও সামরিক নিরাপত্তায় এই রোবটটি কাজ করবে। এটি সামরিক মিশন পরিচালনায়ও সক্ষম হবে। ৬-ডিওএফ মেকানিক্যাল আর্ম, মেটাল ডিটেকশন এবং সিগন্যাল জ্যামিং সিস্টেমের মাধ্যমে বিপজ্জনক বিস্ফোরক শনাক্ত ও নিষ্ক্রিয় করতে সক্ষম।
জিহাদ আরও বলেন, শিল্প কারখানায় নিরাপত্তায় কাজ করবে এই রোভার। কার্বন মনোক্সাইডসহ বিষাক্ত গ্যাস শনাক্ত, লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং এবং জরুরি সরঞ্জাম পৌঁছে দেওয়ার সুবিধাও রয়েছে এতে। সুরক্ষিতভাবে বন্যপ্রাণীকে ট্রাঙ্কুলাইজার ইনজেকশনের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ, আবার কৃষিক্ষেত্রে মাটির আর্দ্রতা, সেচ ও ফসল মনিটরিংয়ে কাজ করবে এই রোবট। যুদ্ধ বা দুর্যোগ এলাকায় ওষুধ, খাবার, পানি পৌঁছে দেওয়া এবং ভয়েস কমিউনিকেশনের মাধ্যমে আশ্বস্ত করতে পারবে এই রোবট। নাইট ভিশন ক্যামেরা, সেন্সর ও লাইভ ট্র্যাকিং সিস্টেম ব্যবহার করে সীমান্ত বা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় নজরদারি করতে পারে এই রোবট। আগামী দিনে হেক্সাগার্ড রোভারে যুক্ত হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি ও দীর্ঘ পরিসরে চলাচলের ক্ষমতা।
দামুড়হুদা উপজেলা একাডেমিক সুপারভাইজর রাফিজুল ইসলাম বলেন, জিহাদের এই প্রকল্পটি অত্যন্ত আধুনিক। এটি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আরও সমৃদ্ধ হবে। এটি জাতীয়ভাবে কাজে লাগাতে পারলে দেশের কল্যাণ বয়ে আনবে। বিশেষ করে সামরিক ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে রোবটটি অত্যন্ত যুগোপযোগী।
চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম বলেন, জিহাদের এই অর্জনে আমরা সত্যিই আনন্দিত। তার এই অর্জনে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল হয়েছে। চুয়াডাঙ্গা সায়েন্স অ্যান্ড রোবোটিক্স ক্লাবের সর্বাত্মক সাফল্য কামনা করি এবং ক্লাবটি আরও দূর এগিয়ে যাক এই প্রত্যাশা করি।
উল্লেখ্য, জিহাদ দেশের ভেতরেও অসাধারণ কিছু সাফল্য অর্জন করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- ৪৬তম জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মেলায় জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম স্থান অর্জন, কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলজাজিরা ইসলামিক সায়েন্স ফেস্ট প্রতিযোগিতায় রানার-আপ, ওয়াইস বাংলাদেশ রাউন্ড-এ সিলভার মেডেল এবং মর্যাদাপূর্ণ ড্রিমস অব বাংলাদেশ স্পেশাল অ্যাওয়ার্ড অর্জন। জিহাদের এই অর্জন নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রেরণা জোগাবে।