- বোরকা পরা দুই চোর তালা কেটে ঢুকে দোকানে
- ভাঙা ছিল তৃতীয় তলার জানালার গ্রিল
- সন্দেহের তীর নিরাপত্তাকর্মীদের দিকে
- বন্ধ ছিল তৃতীয় তলার সিসি ক্যামেরা
রাজধানীর মালিবাগে একটি শপিংমলে জুয়েলারি দোকানের তালা কেটে প্রায় ৫০০ ভরি স্বর্ণ চুরির ঘটনা ঘটেছে। গত বুধবার রাতে মালিবাগের মৌচাক মোড়ের ফরচুন শপিংমলের লেভেল ২-এর ৩৪ নম্বর দোকান শম্পা জুয়েলার্সে এই ঘটনা ঘটে। তবে এ ঘটনায় জড়িত কাউকে শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। জানা গেছে, রাত আনুমানিক ৩টার দিকে দুর্ধর্ষ এ চুরির ঘটনা ঘটে। তবে ৬ষ্ঠ তলাবিশিষ্ট ভবনটির তৃতীয় তলার গ্রিল কাটা অবস্থায় পাওয়া গেছে।
পুলিশ ও শপিংমল কর্তৃপক্ষের ধারণা, গ্রিল কেটে ভেতরে প্রবেশ করে দুই চোর। তবে গ্রিল কাটতে ভেতর থেকে কেউ তাদের সহায়তা করেছে। ঘটনার সময় বন্ধ ছিল তৃতীয় তলার সিসি ক্যামেরা। তবে দ্বিতীয় তলার সিসি ক্যামেরায় বোরকা পরা দুই ব্যক্তির তালা কাটার দৃশ্য ধরা পড়েছে। এ ঘটনায় নিরাপত্তা ঘাটতির পাশপাশি দারোয়ানকে সন্দেহ করছেন ক্ষতিগ্রস্ত দোকান মালিক। তার দাবি, চুরি যাওয়া স্বর্ণের বর্তমান বাজারমূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। দারোয়ানের সহায়তা ছাড়া বাইরের কেউ ভেতরে প্রবেশ ও চুরি করা অসম্ভব। দারোয়ানরা বলছেন, তারা এর সঙ্গে জড়িত নয়। এ ঘটনায় থানা পুলিশের পাশপাশি গোয়েন্দা পুলিশ, সিআইডির ফরেনসিক টিমও কাজ করছে।
জুয়েলার্সের মালিক অচিন্ত কুমার বিশ্বাস বলেন, প্রতিদিনের মতো বুধবার রাত ৯টার দিকে দোকান বন্ধ করে বাসায় যাই। সকালে মার্কেটের দারোয়ান ফোন করে জানান, দোকানে চুরি হয়েছে। এসে দেখি সব শেষ, একটা স্বর্ণও নেই। দোকানে প্রায় ৪০০ ভরির মতো স্বর্ণ সাজানো ছিল। এ ছাড়া আরও ১০০ ভরির বেশি বন্ধকি স্বর্ণ এবং প্রায় ৪০ হাজার টাকা নগদ ছিল। সবকিছু নিয়ে গেছে। আমি এখন নিঃস্ব। আমার আর করার কিছু নেই।
শপিংমলের নিরাপত্তকর্মীদের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, মার্কেটের যারা দারোয়ান আছে তারা জড়িত আমার মনে হয়। তা ছাড়া এ ধরনের কাজ করা সম্ভব না। দারোয়ান অবশ্যই জড়িত। দারোয়ানদের সুপাইভাইজরকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে সব প্রকাশ হবে।
বুধবার রাতে শপিংমলের প্রবেশ গেটে চারজন দারোয়ান দায়িত্বরত ছিলেন। তাদের মধ্যে পঞ্চাশোর্ধ এক দারোয়ান জানান, প্রতিদিন রাতে শপিংমল বন্ধ হওয়ার পর ৭টি গেট লাগিয়ে দেওয়া হয়। মূল গেটে তালা লাগানোর পর তারা চারজন করে বাইরে পাহারারত অবস্থায় থাকেন। তাদের ভেতর ঢোকার কোনো সুযোগ নেই। ভেতরে কোনো শব্দ হলেও কাচের কারণে বাইরে থেকে শোনা যায় না। রাতে তারা কোনো সাড়াশব্দ শুনতে পাননি। বৃহস্পতিবার ভোরে ফজরের নামাজ পড়ার পর তিনি ৬ষ্ঠ তলায় রাউন্ডে যান। সেখান থেকে চেক করতে করতে নিচে নামতে থাকেন। দ্বিতীয় তলায় আসতেই শম্পা জুয়েলার্স দোকানের শার্টার অর্ধেক খোলা দেখতে পান। সঙ্গে সঙ্গে শপিংমলের ইনচার্জ মফিজকে বিষয়টি অবহিত করেন। এরপর মফিজ দোকান মালিককে কল করে ডেকে আনেন। এর বেশিকিছু তিনি জানেন না। তবে এই দারোয়ান তার নাম বলতে রাজি হননি। খোলা ছিল তার নেমপ্লেটও।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে চুরির বিষয়টি জানাজানি হলে রমনা থানা-পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের একাধিক দল ও সিআইডির কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। তারা শপিংমলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে চোরদের শনাক্তে কাজ শুরু করে। অন্যদিকে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেও রাজধানীর শপিংমল থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ চুরির ঘটনায় দোকান মালিকদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তারা দ্রুত চোরদের গ্রেপ্তার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে দুর্ধর্ষ এই চুরির একটি ভিডিও ফুটেজ শপিংমলের সিসি ক্যামেরায় ধারণ হয়েছে। আট মিনিটের ভিডিও ফুটেজে কালো রঙের বোরকা পরিহিত দুই ব্যক্তিকে দেখা যায়। যাদের মুখম-ল কালো কাপড় দিয়ে বাঁধা ছিল। একজনের কাঁধে শাবল, আরেকজনের হাতে শপিং ব্যাগ, টর্চলাইট ও তালা কাটার বিভিন্ন যন্ত্র। তারা দ্বিতীয় তলার ফ্লোরে ঘোরাফেরা করতে থাকে। একপর্যায়ে শম্পা জুয়েলার্সের সামনে এসে দাঁড়ায়। সেখানে একজন দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিক দেখতে থাকে, আরেকজন আবারও ফ্লোরে ঘুরে দেখে।
লম্বা শাবল দিয়ে সিসি ক্যামেরা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। দুজন একত্র হয়ে শপিং ব্যাগ থেকে তালা কাটার যন্ত্র বের করে। তা দিয়ে শাটারের সামনের অংশে থাকা কলাপসিবল গেটের তালা কাটে। এরপর কলাপসিবল গেট ডান দিকে অর্ধেক টেনে শাটারের তালা কেটে অর্ধেক উপরে তোলে ভেতরে প্রবেশ করে দুজন। সেখান থেকে কয়েক মিনিট পর বাইরে বের হয়ে আসে। এ সময় একজনের হাতে থাকা শপিং ব্যাগ বেশ ফোলা অবস্থায় দেখা যায়। তারা দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। এ সময় একজন বোরকা তুলে কোমরে কিছু একটা গুঁজে রাখে। তখন তার পরনে চেক লুঙ্গি দেখা যায়। তারপর দ্বিতীয় তলা থেকে চলে যান তারা। পুরো সময় তারা তাড়াহুড়ো না করে ধীরস্থিরভাবে চুরি সম্পন্ন করেন।
রমনা থানার ওসি গোলাম ফারুক বলেন, মালিবাগের ফরচুন শপিংমলের দ্বিতীয় তলায় শম্পা জুয়েলার্স। এই দোকান থেকে ৫০০ ভরি স্বর্ণালংকার চুরি হয়েছে বলে দোকান মালিকের অভিযোগ। তিনি মামলার আবেদন নিয়ে থানায় এসেছেন। আমরা শনাক্তে কাজ শুরু করেছি।
ওসি বলেন, আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেছি শপিংমলের পেছনের তৃতীয় তলার জানালার গ্রিল ভাঙা। ধারণা করা হচ্ছে, এখান দিয়েই চোর শপিং মলের ভেতরে ঢোকে। পরে তারা দ্বিতীয় তলার শম্পা জুয়েলার্সের শাটার ভাঙে। দোকানের ভেতরে ঢুকে শোকেসে রাখা স্বর্ণালংকার তারা চুরি করে নিয়ে যায়।
এর আগে গত রোববার (৫ অক্টোবর) যাত্রাবাড়ীতে একটি জুয়েলারি দোকানের দেয়াল কেটে প্রায় ১২৫ ভরি স্বর্ণালংকার ও পৌনে ৩ লাখ টাকা চুরি করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় মঙ্গলবার মামলা হলেও জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. মাসুদ আলম সাংবাদিকদের বলেন, আমরা সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করছি এবং চোরদের ধরতে একাধিক দল কাজ শুরু করেছে। শপিংমলের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে, যার তদন্ত করা হবে। যাত্রাবাড়ীর ঘটনার সঙ্গে এই চুরির কোনো যোগসূত্র আছে কি না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তিনি বলেন, শপিংমলের সামনে নিরাপত্তাকর্মীরা দায়িত্বরত ছিলেন। রাতে মার্কেট বন্ধ করে দোকান মালিক-কর্মচারীরা বাসায় চলে যান। এরপরই চোর শপিংমলের পেছনের জানালার গ্রিল ভেঙে ভেতরে ঢোকে। সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে চোর শনাক্তসহ লুট হওয়া স্বর্ণালংকার উদ্ধারের চেষ্টা চলছে বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ আলম। তবে তিনি বলেন, চুরি হওয়া স্বর্ণের পরিমাণ নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে দাবি করেছেন তিনি।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন