ঢাকা মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

জুলাই আন্দোলনে গুলিতে পক্ষাঘাতগ্রস্ত মুসার ইচ্ছা ছিল পাইলট হবে

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০২৫, ০১:২৫ এএম
  • দাদির সঙ্গে আইসক্রিম খেতে নেমে বাধে বিপত্তি
  • পুলিশের গুলি মুসার মাথা ভেদ করে দাদির পেটে লেগে মারা যান তিনি

জুলাই গণআন্দোলন চলাকালে গুলিতে একপাশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে গেছে ছয় বছর বয়সি মো. বাসিত খান মুসার, যার ইচ্ছা ছিল বড় হয়ে পাইলট হওয়ার। রামপুরায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দেওয়ার পর গতকাল সোমবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বাইরে সাংবাদিকদের কাছে ছেলের এ ইচ্ছার কথা তুলে ধরেন মুসার বাবা মো. মোস্তাফিজুর রহমান। এদিন এ মামলায় ২ নম্বর সাক্ষী ছিলেন মোস্তাফিজুর। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাক্ষ্য দেন তিনি।

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই রামপুরার বনশ্রীতে গুলিতে মুসার দাদি মায়া ইসলামসহ দুইজন নিহত হন। এ ঘটনায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিব, রামপুরা থানার ওসি মশিউর রহমান, কনস্টেবল চঞ্চল চন্দ্র সরকারসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

এ মামলায় এদিন সাক্ষ্য দেওয়ার পর রাজধানীতে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামের ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমার ছেলের ইচ্ছা ছিল পাইলট হবে, প্লেন চালাবে। তাই ইংলিশ ভার্সনে পড়াচ্ছিলাম। ক্লাসে ফার্স্ট ছিল। এখন তো তার ডান পাশটা প্যারালাইজড (পক্ষাঘাতগ্রস্ত)। মুখ দিয়ে খেতে পারে না। এনজি টিউব দিয়ে খাবার দিতে হয়। কথা বলতে পারে না, তবে বুঝতে পারে। প্রথম থেকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা হচ্ছে। চিকিৎসকেরা বলেছেন ভালো হয়ে যাবে, তবে সময় লাগবে।’

ছেলের আহত হওয়ার সেই দিনের বর্ণনা দিয়ে এর আগে তিনি সাক্ষ্যে বলেন, ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার বিকেল ৩টা সাড়ে ৩টার দিকে বাবাকে খাবার পৌঁছে দেওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হচ্ছিলেন। ওই সময় ছেলে মুসা আইসক্রিম খেতে চায়। তখন তিনি তার মা ও ছেলে মুসাকে নিয়ে বাসার নিচে নামেন, যাতে আইসক্রিম নিয়ে ছেলে দাদির (মোস্তাফিজের মা) সঙ্গে বাসায় ফিরতে পারে।

তিনি বলেন, বাসার নিচে নামার পর গেটের বাইরে থেকে পুলিশের ছোড়া একটি গুলি ছেলে মুসার মাথায় লেগে মাথা ভেদ করে পেছন দিয়ে বের হয়ে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে তিনি ছেলেকে কোলে করে পাশের ফেমাস হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পৌঁছান। ফোন করলে তার বাবা ও স্ত্রী সেখানে যান। পরে চিকিৎসকেরা মুসার মাথায় অস্ত্রোপচার করেন।

আমার বাসা থেকে আনুমানিক ৭০ ফুট দূরে রামপুরা থানা ভবন অবস্থিত। আমি আমার বাসার গেট থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম ওই থানার ওসি মশিউর রহমানসহ আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্য সরাসরি গুলি করছিল।

মোস্তাফিজুর বলেন, ঢাকা মেডিকেল থেকে ফোনে মাকে না পেয়ে এক প্রতিবেশীকে ফোন করে তাদের ফ্ল্যাটে গিয়ে তার মায়ের খোঁজ করতে বলেন। ওই প্রতিবেশী বলেন, মুসার মাথায় যে গুলি লেগেছিল সেটা তার মাথা ভেদ করে ছেলের দাদি মায়া ইসলামের পেটে লেগেছে। ওই সময়েই তিনি তার মায়ের গুলিবিদ্ধ হওয়ার বিষয়টি জানতে পারেন বলে আদালতকে বলেন।

ওই প্রতিবেশীর বরাতে মোস্তাফিজুর বলেন, তারা তার মাকে তাৎক্ষণিকভাবে ফরাজি হাসপাতালে ভর্তি করান। তার স্ত্রী বাসার বাইরে থাকায় মাকে প্রতিবেশীরা হাসপাতালে নিয়ে যান। বাইরে অনেক গোলাগুলি হওয়ায় ওই সময় তিনি ঢাকা মেডিকেল থেকে বের হয়ে ফরাজী হাসপাতালে যেতে পারেননি।

সেই দিনের দুর্যোগের মুহূর্ত তুলে ধরে তিনি বলেন, তার ফোন পেয়ে তাদের এক আত্মীয় সারোয়ার হোসেন ফরাজী হাসপাতালে যান। সেখানে চিকিৎসকেরা তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু গাড়ি না পাওয়ায় তিনি তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিতে পারেননি। বাইরে তখন অনেক গোলাগুলি হচ্ছিল। ওই দিন রাত ১১টার দিকে আমি আমার বাবাকে ফরাজী হাসপাতালে পাঠাই। রাতে অ্যাম্বুলেন্স না পাওয়ায় বাবাও মাকে ঢাকা মেডিকেলে আনতে পারেননি। পরদিন ভোর ৫টার দিকে আমি ঢাকা মেডিকেল থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে ফরাজী হাসপাতালে পাঠাই। ওই অ্যাম্বুলেন্সে করে মাকে নিয়ে বাবা ঢাকা মেডিকেলে আসেন। পথিমধ্যে মায়ের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। হাসপাতালে নামানোর পর চিকিৎসকেরা মায়ের ইসিজি করেন এবং তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ সময় সাক্ষী মোস্তাফিজুর কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলে মুসা ২৬ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত আইসিইউতে ভর্তি ছিল। এরপর তাকে সিএমএইচে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত আইসিইউতে ভর্তি ছিল। এরপর অবস্থার অবনতি হতে থাকলে চিকিৎসকের পরামর্শে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ২০২৪ সালের ২৩ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সিঙ্গাপুরে তার চিকিৎসা হয়। সরকার তার সব চিকিৎসার খরচ বহন করেন বলে মোস্তাফিজুর জানান।

তিনি বলেন, সিঙ্গাপুর থেকে আনার পর এ বছরের ৯ জুলাই পর্যন্ত তাকে আবার সিএমএইচে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। ৯ জুলাই তাকে আবার সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয়। ২৬ জুলাই পর্যন্ত সেখানে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

বাবার সঙ্গে মুসাও গতকাল ট্রাইব্যুনালে এসেছিলেন। তার মাথায় গুলির ক্ষতচিহ্ন এবং চিকিৎসার সরঞ্জামাদি দেখা যায়। মোস্তাফিজুর তার মায়ের হত্যা এবং সন্তানের এই অবস্থার জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার দাবি করেন।