- বন্দোবস্ত, ক্রয় ও ওয়ারিশ সূত্রে একশ একর জমির মালিক ভূমিহীন অর্ধশত কৃষক
- ৫ আগস্টের পর এসব জমি জোরপূর্বক দখল করেন প্রভাবশালী পাঁচ ব্যক্তি
- প্রশাসনের পক্ষ থেকে কৃষকদের জমি ভোগদখলের আদেশ দিলেও মানেননি প্রভাবশালীরা
ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ এলাকা মুজিবনগর ইউনিয়ন। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর এখানকার একশ একর কৃষিজমি অবৈধভাবে জোরপূর্বক দখলে নিয়েছেন প্রভাবশালী পাঁচ ব্যক্তি। এদের ক্ষমতার প্রভাবে নিরুপায় ভূমিহীন কৃষকরা তাদের কৃষিজমি হারিয়ে বিপাকে রয়েছেন। উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) উভয় পক্ষের কাগজপত্র দেখে প্রকৃত কৃষকদের জমি ভোগদখল নেওয়ার আদেশ দিলেও প্রভাবশালীরা তা অমান্য করে রাতের আঁধারে জমিতে ধান বপন করেন। এসব অভিযোগ করেছেন ওই এলাকার ভূমিহীন প্রায় অর্ধশত কৃষক। মুজিবনগর ইউনিয়নে প্রায় ১৩ হাজার মানুষের বসতি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, নদী ভাঙনের পর বসতভিটা ও ফসলি জমি হারিয়ে এখানকার ভূমিহীন পরিবারগুলো মুজিবনগর ইউনিয়নে আশ্রিত হয়ে সরকারের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্তের আবেদন করেন। সেসব ভূমিহীন পরিবারগুলোকে চর মনোহর মৌজায় ৪ ও ৫ নম্বর সিটে দেড় একর করে জমি বন্দোবস্ত দেয় সরকার। তখন তারা সেখানে বসতি স্থাপন করেন। এর মধ্যে দেড় একর করে জমি বন্দোবস্ত পাওয়ার পরেও অনেকেই আরেক বন্দোবস্তীয় মালিকের কাছ থেকে জমি ক্রয় করেন। সব মিলিয়ে বন্দোবস্ত, ক্রয় ও ওয়ারিশ সূত্রে একশ একর জমির মালিক রয়েছেন ভূমিহীন অর্ধশত কৃষক। দীর্ঘ সময় ধরে এসব জমিতে কৃষকরা বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করে আসছেন।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পলায়নের পর স্থানীয় প্রভাবশালী পাঁচ ব্যক্তিÑ সিরাজ বেপারী, হারিছ বেপারী, রুবেল বেপারী, আলিম হাওলাদার ও বাবুল কন্ট্রাক্টর তাদের নিজস্ব ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে অধর্শত ভূমিহীন কৃষকের একশ একর ভোগদখলীয় জমি অবৈধভাবে দখল করে নেন। এসব কৃষকরা তাদের নিজেদের জমি ফিরে পেতে বিভিন্ন দপ্তর ও ব্যক্তির কাছে গিয়েও কোনো প্রতিকার পাননি। ৫ আগস্টের পর থেকে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের অব্যাহত হুমকি-ধমকিতে অনেক কৃষক এলাকা ছাড়া হয়েছেন।
ভুক্তভোগী কৃষক ইউনুস হাওলাদার বলেন, ‘প্রায় ৪০ বছর আগে বসতভিটা ও ফসলি জমি নদী ভাঙনের পর মুজিবনগর ইউনিয়নে আশ্রয় নেই। সরকার আমার নামে দেড় একর জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার পর আমি আরেকজন বন্দোবস্তীয় মালিকের কাছ থেকে আরও দেড় একর জমি ক্রয় করি। কয়েক বছর ধরে চর মনোহর মৌজায় ৪ নম্বর সিটের ৪১৮ ও ৪১০ খতিয়ানের তিন একর জমিতে চাষাবাদ করে আসছি। কিন্তু ৫ আগস্টের পর মো. সিরাজ আমার জমি দখল করে। আমি এক বছরেরও বেশি সময়ে ধরে জমি চাষাবাদ করতে পারছি না। এ বিষয়ে আমরা কৃষকরা উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) বরাবর লিখিত অভিযোগ করি। তিনি উভয় পক্ষকে ডেকে কাগজপত্র পর্যালোচনা করেন দেখেন, আমরা ভূমিহীনরাই সঠিক রয়েছি। তাই আমাদের জমি দখল নিতে তিনি আদেশ দিয়েছেন।’
একই এলাকার কৃষক আঃ খালেক ফরাজী বলেন, ‘এই চরে আমার পরিবার নিয়ে প্রায় ৩০ বছর ধরে বসবাস করছি। কৃষিকাজই আমার মূল পেশা। নিজের ও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করছি। দিয়ারা ২১ ও ২২ খতিয়ানে ৩ একর জমির মালিক আমি। প্রভাবশালী পাঁচ ব্যক্তি আমার জমি দখল করে নিয়েছে। এমনকি আমার বর্গাচাষের জমিও তারা নিয়ে গেছে। আমি এখন নিরুপায়। চাষাবাদের আয় দিয়ে আমার পাঁচ সদস্যের পরিবারের ভরণ পোষণ চলে। আমি এক বছর ধরে বেকার, আয়ের পথ বন্ধ। বিভিন্ন জনের ধারে ঘুরেও জমি ফিরে পাইনি।’
একইভাবে আনিছ পাটোয়ারী, খোকন হাওলাদার, রশিদ, আঃ হাসেম, মন্নান, ইউনুছ ও আঃ মালেকসহ অর্ধশত কৃষক তাদের ভোগদখলীয় জমি হারিয়ে বিপাকে রয়েছেন।
অভিযুক্তদের মধ্যে রুবেল বেপারীর সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রকৃত মালিকদের কাছ থেকে জমি রাখিনি। আগে যাদের কাছে এসব জমি দখলে ছিল, তাদের কাছ থেকে আমরা জমি দখলে নিয়ে অন্যান্য চাষাদের কাছে লগ্নি দিয়েছি।’ প্রকৃত কৃষকরা জমি ফিরে পাবে কীভাবেÑ এমন প্রশ্নের জবাব রুবেল এড়িয়ে যান। এ ছাড়াও অন্য চার অভিযুক্ত সিরাজ বেপারী, হারিছ বেপারী, আলিম হাওলাদার ও বাবুল কন্ট্রাক্টরকে সরেজমিনে গিয়েও তাদের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। তাদের মোবাইল নম্বর বন্ধ থাকায় বক্তব্য জানা যায়নি।
এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এমাদুল হোসেন বলেন, ‘জমির প্রকৃত মালিকদের কাগজপত্র সঠিক। তাদের জমি ভোগদখল করার জন্য বলা হয়েছে।’

