পুলিশ বাহিনীর সংস্কারের অংশ হিসেবে তাদের ইউনিফর্ম পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিল অন্তর্বর্তী সরকার। ইতিমধ্যে নতুন ইউনিফর্ম তৈরি হয়েছে এবং পুলিশকে তা সরবরাহ করা হচ্ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশ নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালনও শুরু করেছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নতুন ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা যাচ্ছে। পুলিশের এই নতুন পোশাক নিয়ে বাহিনীর ভেতরে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। অধিকাংশ সাধারণ মানুষ বলছেন, পুলিশের নতুন পোশাকটি ভালো হয়নি। আবার অনেকে বলছেন, ভালোই হয়েছে। নতুন পোশাকের সঙ্গে সঙ্গে বাহিনীর মানসিকতাও পরিবর্তন হবে এবং তারা প্রকৃত অর্থে জনগণের বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়াবে বলে আশা করছেন তারা। আবার পুলিশ বাহিনীর ভেতরে অনেকে এই পোশাক নিয়ে সন্তুষ্ট নন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে দমন-পীড়নের অভিযোগ ওঠার পর থেকে সমালোচনার মুখে থাকা পুলিশ বাহিনীর সংস্কার ও পোশাক পরিবর্তনের দাবি উঠলে অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশের জন্য নতুন ইউনিফর্ম অনুমোদন করে। এর অংশ হিসেবে আয়রন কালারের (লৌহ রঙের) নতুন পোশাক তৈরি করা হয়েছে। পুলিশের সব ইউনিট যেমন- পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), ট্যুরিস্ট পুলিশ, হাইওয়ে পুলিশ, নৌ পুলিশÑ সবাই এই একই পোশাক পরবে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে জেলা পুলিশ ও মেট্রোপলিটন পুলিশে ইউনিফর্মের রং ভিন্ন। কিন্তু নতুন ইউনিফর্ম হবে সবার জন্য এক রঙের। ১৬ নভেম্বর থেকে ঢাকা মেট্রোপলিটনসহ (ডিএমপি) সব মেট্রোপলিটন পুলিশ সদস্য নতুন ইউনিফর্ম পরতে পারবেন বলা হয়েছিল। ঢাকায় সেটি শুরু হয়েছে। অন্য মেট্রোপলিটন এরিয়ায় কয়েক দিনের মধ্যে শুরু হবে। জেলা পুলিশের নতুন ইউনিফর্ম পেতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের অবস্থান আন্দোলনকারীদের বিপক্ষে ছিল। গণঅভ্যুত্থানে বিগত সরকার পালিয়ে যাওয়ার পর এবং অভ্যুত্থানের বিপক্ষে অবস্থানের কারণে বাহিনীটির মনোবল কমে যায়। মনোবল বৃদ্ধি করার জন্য বর্তমান সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হয়। সামনে যেহেতু জাতীয় সংসদ নির্বাচন, সেক্ষেত্রে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ থেকে শুরু করে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে পুলিশকে। তাই নির্বাচনের আগে পুলিশকে চাঙ্গা করতে নতুন ইউনিফর্ম বাহিনীটির গায়ে তুলে দিচ্ছে সরকার।
নতুন ইউনিফর্ম নিয়ে নাগরিকদের প্রতিক্রিয়া :
গত ১৬ নভেম্বর ঢাকা মহানগর পুলিশসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে নতুন পোশাক বিতরণ শুরু হয়েছে। পুলিশের অনেক সদস্য নতুন পোশাক পরে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালনও করছেন। তবে এখনো পুরো বাহিনীকে নতুন পোশাক দেওয়া হয়নি। প্রাথমিক পর্যায়ে মেট্রোপলিটন পুলিশকে পোশাক দেওয়া হবে, পরে আস্তে আস্তে রেঞ্জ পুলিশসহ ইউনিটগুলোকে দেওয়া হবে।
মিশ্র আলোচনা :
ঢাকায় মাঠ পর্যায়ে পুলিশের গায়ে নতুন ইউফির্ম দেখে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে নানা মহলে চলছে মিশ্র আলোচনা। অনেকে পুলিশের নতুন পোশাকের ছবি পোস্ট করে সমালোচনা করছেন, আবার কেউ কেউ প্রশংসাও করছেন। মোহাম্মদ আব্দুস সালাম নামে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের এক বাসিন্দা পুলিশের নতুন পোশাক নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, নতুন পোশাকে ‘পুলিশ পুলিশ’ বলে মনে হয় না। আগের পোশাক সুন্দর ছিল। তবে পোশাক পরিবর্তন করতে চাইলে করা যেত, কিন্তু সেটি আরও ভালো মানের করা উচিত ছিল। এখন সাধারণ কোনো কোম্পানির নিরাপত্তাকর্মীদের মতো লাগছে। তবে আমরা চাই পুলিশ যে পোশাকেই আসুক না কেন, পুলিশ যেন জনগণের বন্ধু হয়; কোনো সরকারের আদেশ পালন করতে গিয়ে দমন-পীড়ন যেন না করে।
নতুন পোশাককে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাকের সঙ্গে তুলনা :
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ বিভিন্ন পোস্ট দিয়ে পুলিশের নতুন পোশাককে সিকিউরিটি গার্ডের পোশাকের সঙ্গে তুলনা করছেন। তারা লিখছেন, এটা সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক হয়েছে, একটি পেশাদার পুলিশ বাহিনীর পোশাক নয়। এই পোশাক অপরাধীদের মনে মনস্তাত্ত্বিক কোনো প্রভাব ফেলবে না। তাই পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের আগে আরও চিন্তা করে পরিবর্তন করা উচিত ছিল।
সমালোচনার পাশাপাশি আছে প্রশংসাও :
সমালোচনার পাশাপাশি অবশ্য প্রশংসাও আছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীরা মনে করছেন, পুলিশের এই পোশাক মানানসই হয়েছে। পূর্বের কৃতকর্মের যে কালিমা লেপে ছিল তাদের আগের পোশাকে, সেটি দূর হয়ে গেছে। রাজধানীর একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সায়মা আক্তার বলেন, পুলিশের আগের পোশাকের সঙ্গে শহিদদের রক্তের দাগ লেগে আছে। তাই পোশাক পরিবর্তন সরকারের একটি ভালো সিদ্ধান্ত। আমরা এটিকে স্বাগত জানাই। রুবেল বলেন, নতুন বাংলাদেশে পুলিশকে আমরা নতুনভাবে দেখতে চাই। নতুন পোশাকের ফলে তাদের প্রতি মানুষের মনে নতুন করে আস্থা ও ভালোবাসা তৈরি হবে। আমরা চাই শুধু পোশাক পরিবর্তন নয়, পুলিশ তাদের মানসিকতাটাও পরিবর্তন করবে এবং সব সময় জনগণের পাশে দাঁড়াবে। রাজধানীর পল্টন এলাকায় পুলিশের নতুন পোশাক দেখে মোটরসাইকেলযাত্রী রহিম মিয়া বলেন, পুলিশের নতুন পোশাকটি আমাদের খুব পছন্দ হয়েছে। আগের পোশাক দেখলে ভয় লাগত। এখন পোশাক দেখলে আস্থা জাগছে পুলিশের প্রতি। আশা করছি, নতুন পোশাকে পুলিশ সাধারণ জনগণের বন্ধুর মতো হবে।
পোশাক নিয়ে বাহিনীর ভেতরেও আলোচনা :
এদিকে নতুন পোশাকের রঙ নিয়ে পুলিশের অনেক সদস্য সন্তুষ্ট নন বলে জানা গেছে। এর আগে বিভিন্ন সময় একাধিক বৈঠকে নতুন পোশাকের রঙ নিয়ে পুলিশ সদস্যরা অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছিলেন। মহানগর পুলিশে কর্মরত উপপরিদর্শক থেকে ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের নতুন পোশাক পছন্দ হয়নি। আবার অনেক পুলিশ সদস্য নতুন পোশাককে খুশি মনে গ্রহণ করেছেন।
এখন সব ইউনিটের ইউনিফর্ম একই রঙের হবে :
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপিতে কর্মরত ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, এখন পুলিশের সব ইউনিটের ইউনিফর্ম একই রঙের হবে। মেট্রোপলিটন পুলিশও পরবে আয়রন রঙের ইউনিফর্ম, আবার জেলা পুলিশও পরবে একই রঙের ইউনিফর্ম। আগে তো ভিন্ন ভিন্ন ইউনিফর্ম ছিল, সে কারণে মেট্রোপলিটন পুলিশ ও জেলা পুলিশের মধ্যে পার্থক্য ছিল এবং বোঝা যেত। এখন তো আর বোঝা যাবে না। এটা একটা সমস্যা হতে পারে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ডিএমপির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, ইউনিফর্ম কিংবা রঙ পরিবর্তন আসল বিষয় না। জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে জনমনে যে বিরূপ ধারণা রয়েছে, সেটাকে পরিবর্তন করতে হবে। পুলিশকে জনবান্ধব করতে হবে, সেই দায়িত্ব পুলিশকেও নিতে হবে এবং সরকারকেও নিতে হবে। উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার আরেক কর্মকর্তা বলেন, পুলিশের নতুন ইউনিফর্মে আমরা খুশি হয়েছি। আমরা আর আগের ইউনিফর্ম পরতে চাই না। আগের ইউনিফর্ম দেখলে মানুষ আমাদের ভিন্ন চোখে দেখে এবং জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে পুলিশের কার্যক্রম নিয়ে তারা নানা কথা বলে। নতুন পোশাক ভালো হয়েছে এবং নতুন ইউনিফর্ম পরে আমরা সবাই নতুন উদ্যমে জনগণের পাশে দায়িত্ব পালন করব।
আবহাওয়ার কথা মাথায় রেখে তৈরি হয়েছে নতুন পোশাক :
বিশ্বজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক দুইভাবে নির্ধারণ করা হয়। দেশ-কালের ওপর ভিত্তি করে সেবা সংস্থাগুলোর পোশাক নির্ধারণ করা হয় বেশির ভাগ সময়। যেমনÑ শীতপ্রধান দেশগুলোর পুলিশের পোশাকের রঙ হয় কালো। সেখানে তাপমাত্রা ধরে রাখার একটা বিষয় পোশাকে যুক্ত থাকে। গরম বা নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলোতে পুলিশের পোশাক সাদা, খয়েরি বা হালকা রঙের দেখা যায়, যা কিনা তাপ শোষণ কম করে। ভারত বা এ অঞ্চলে বিভিন্ন সেবা সংস্থার পোশাক খাকি হওয়ার আরেকটি কারণ ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ইতিহাস।
পরিবেশ ও সব ধরনের আবহাওয়ায় মানানসই :
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, নতুন পোশাকের কাপড় পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে দেশের পরিবেশ ও সব ধরনের আবহাওয়ার সঙ্গে মানানসই কি না। পাশাপাশি কাপড়ের মানও যাচাই করা হয়েছে। নতুন ইউনিফর্মের রঙ বাহিনীর জন্য উপযুক্ত কি না এবং সদস্যরা সেই পোশাক পরে আরাম অনুভব করছেন কি না, তা-ও দেখা হয়েছে। ইউনিফর্ম চূড়ান্ত হওয়ায় রঙের সঙ্গে সমন্বয় রেখে চূড়ান্ত হয়েছে ব্যাজের রং।
ডিএমপির সব সদস্যের হাতে নতুন পোশাক পৌঁছায়নি :
পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) এ এইচ এম শাহাদাত হোসাইন বলেন, জেলা ও রেঞ্জ পুলিশ পর্যায়ক্রমে নতুন এই পোশাক পরবেন। তবে পুলিশের বিশেষায়িত ইউনিট আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) ও স্পেশাল প্রটেকশন ব্যাটালিয়নের (এসপিবিএন) আগের পোশাক থাকবে।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, এখনো ডিএমপির সব সদস্যের হাতে নতুন পোশাক পৌঁছায়নি। এক দিন আগে থেকে পোশাক বিতরণ শুরু হয়েছে। যারা নতুন পোশাক পেয়েছেন, তারা ইতিমধ্যে নতুন ইউনিফর্ম পরে মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। আর যারা এখনো পাননি, তাদের পোশাক পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে।

