বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) ত্রয়োদশ কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন। এর আগে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আগামী নির্বাচন ও সমসাময়িক নানা বিষয় নিয়ে তিনি মুখোমুখি হয়েছেন রূপালী বাংলাদেশের। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার সেলিম আহমেদ
রূপালী বাংলাদেশ : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেড় বছরের বেশি সময় পার হলো। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন দেখছেন?
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : সমাজের নানা বৈষম্য নিয়ে মানুষের মনে থাকা ক্ষোভ-বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করেছিলেন পরে সেখানে সম্পৃক্ত হন সমাজের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ। এই অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছিল। গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষা ছিল একটি বৈষম্যবিরোধী সমাজ গঠন। কিন্তু তা অধরা রয়ে গেছে। এখানে সমস্যা হয়েছে অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু যে ব্যবস্থা একটি সরকারকে ফ্যাসিস্ট করে তোলে তার কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমরা ১৬ বছরে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারের আমলে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রশাসন, আমলাতন্ত্র, ভারত-আমেরিকার আধিপত্য, লুটেরাদের লুটপাট দেখেছি, তার সবই এখনো বহাল আছে। ফলে অভ্যুত্থানের পর কিছু একটা হওয়ার যে সম্ভাবনা ছিল তা বাস্তবায়ন হয়নি।
রূপালী বাংলাদেশ : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর সরকার নানা বিষয়ে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছিল। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন কয়েক মাস আলোচনা করে একটি সংস্কার প্রস্তাব তৈরি করেছে। এ বিষয়ে আপনার মূল্যায়ন কী?
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি সব সময় সংস্কারের পক্ষে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব হলো একটা অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে বিদায় নেওয়া। জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রের যা সংস্কার করার প্রয়োজন তা করবে। কিন্তু আমরা দেখলাম অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন করল। কিন্তু সবচেয়ে জরুরি যে বিষয় ছিলÑ শিক্ষা ও কৃষি, তা নিয়ে নিয়ে কোনো সংস্কার কমিশন গঠন করল না। আবার এসব কমিশনের মধ্যে মাত্র ৬টি সংস্কার কমিশন কাজ করেছে, বাকিগুলোর কোনো গতি হলো না। যে কমিশনগুলো কাজ করেছিল তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সংবিধান সংস্কার করা। সংবিধান পরিবর্তন ছিল তাদের দীর্ঘদিনের লক্ষ্য। আমরাও বলছিÑ সংবিধানের সংস্কার আমরা চাই, তবে সেটা অবশ্যই নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে হতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো এখতিয়ার নেই সংবিধান সংস্কার করার। সংবিধান সংস্কার করতে গিয়ে তারা মূল চার নীতির ওপর আঘাত এনেছে।
রূপালী বাংলাদেশ : সরকার বলছে ফেব্রুয়ারির মধ্যভাগে নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশনও তপশিল ঘোষণা করেছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। এ বিষয়ে আপনি কি ভাবছেন?
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : আজকের বাংলাদেশে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তা থেকে বের হয়ে আসতে হলে একটা নির্বাচিত সরকার প্রয়োজন। তবে মানুষের মধ্যে এখনো সংশয় আছে নির্বাচন নিয়ে। আমরা যখন গ্রামগঞ্জে যাই, মানুষ নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন করে। সরকারের নানা কর্মকা-ের কারণে এ প্রশ্নটি সামনে আসছে। তবে আমরা মনে করতে চাইÑ নির্বাচন হবে। নির্বাচনের দাবিতে আমরা অনড়।
রূপালী বাংলাদেশ : বন্দর করিডোর নিয়ে দেশের বামদলগুলো দীর্ঘদিন থেকে আন্দোলন করছে। সর্বশেষ আপনাদের বন্দর ইস্যুতে যমুনা ঘেরাও কর্মসূচিতে লাঠিচার্জ করল পুলিশ। তবে সরকার বলছে বন্দর-করিডোর ইজারা দিলে কর্মসংস্থান ও রাজস্ব বাড়বে। তারপরও কেন আন্দোলন?
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : সরকারের এই বক্তব্যের সঙ্গে আমরা একমত নই। বন্দরটা শুধু আমদানি-রপ্তানি কর্মকা- পরিচালনা কিংবা কর্মসংস্থানের বিষয় নয়। বন্দরের সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিষয় জড়িত। কারণ দীর্ঘদিন থেকে আমাদের গভীর সমুদ্রবন্দরে আমেরিকাসহ সাম্রাজ্যবাদীরা সামরিক ঘাঁটি বসানোর নানা চেষ্টা করছে। তারা তাদের ভূরাজনীতির স্বার্থে বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চায়। আমেরিকান কোম্পানি বন্দর লিজ নিলে কত টাকা লাভ করবে? মূলত আমেরিকা, চায়না ও ভারত দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশের বন্দর ইজারা নিয়ে কে কার ওপর আধিপত্য রাখবে তা নিয়ে লড়াই করছে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর আমেরিকান কোম্পানিকে লিজ দেওয়ার ফলে এখানে আমেরিকান জাহাজ আসবে, সামরিক অস্ত্র আসবে। তারা চেষ্টা করবে কিভাবে চীন কিংবা ভারতকে দমানো যায়। ভারত-চীন চেষ্টা করবে আমেরিকা যাতে না আসতে পারে। সব মিলিয়ে আমাদের দেশটা অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে এসব সিদ্ধান্তের ফলে।
রূপালী বাংলাদেশ : জুলাই সনদ নিয়ে অনেক কথা হচ্ছে। এই সনদ বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপথ কি নির্ধারণ করতে পারবে?
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : জুলাই সনদ বাংলাদেশের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আনবে না। জুলাই সনদের মূল বক্তব্য কী? আমরা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে অনেকবার বসেছিলাম। সেখানে ১৬৪টি প্রস্তাব এসেছিল। তা কমে ৮৪টি হয়েছে। এর মধ্যে ২০টি প্রস্তাবে আমরা একমত হইনি। আমরা বলেছিলাম যেসব বিষয়ে সবাই একমত হয়েছে সেই বিষয়গুলো নিয়ে একটি সনদ হতে পারে। যেটা পরবর্তী সংসদ বাস্তবায়ন করবে। তারা আমাদের কথা নয়, বরং তাদের এজেন্ডার মধ্যেই গেছে। গণভোটের যে বিষয়টি এসেছে আমরা কমিউনিস্ট পার্টি মনে করিÑ তা অপ্রয়োজনীয়। আমাদের সংবিধানে গণভোটের কথা উল্লেখ নেই। আর গণভোট হলে একটা ইস্যুতে হতে পারে। চার-পাঁচটি বিষয়ে গণভোট আমাদের দেশে কখনো হয়নি।
রূপালী বাংলাদেশ : নির্বাচন কমিশন বলছে গণভোট ও জাতীয় নির্বাচন একদিনে হবে। প্রবাসী পোস্টাল ভোট নেওয়া হবে। আমাদের নির্বাচন কমিশনের কি একসঙ্গে সব কাভার করার সক্ষমতা আছে।
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : পোস্টাল ভোট অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের কাছে মূখ্য। গণভোট নিয়ে আমরা কিছু বলছি না। এটাকে অপ্রয়োজনীয় মনে করি।
রূপালী বাংলাদেশ : আপনারা গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট করার উদ্যোগ নিয়েছেন। এই ফ্রন্টে কারা থাকবে?
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : আমাদের পার্টির সর্বশেষ কংগ্রেসে একটি সিদ্ধান্ত হয়েছেÑ দেশের প্রচলিত রাজনীতির কারণে কোনো বিজয়কে আমরা ধরে রাখতে পারিনি। প্রত্যেকটা আন্দোলনের সুফল হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধকে বিশ^াস করে এই ধরনের সব রাজনৈতিক দল, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক ব্যক্তি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, পির-দরবেশসহ নিপীড়িত মানুষ, সংগঠন সবাইকে নিয়ে আমরা এই ফ্রন্ট করতে চাই।
রূপালী বাংলাদেশ : আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে আপনাদের প্রস্তুতির বিষয়ে জানতে চাই।
কাজী সাজ্জাদ জহির চন্দন : আমরা আমাদের দলের প্রার্থী এখনো চূড়ান্ত করিনি। তবে যত সম্ভব বেশি সংখ্যক আসনে প্রার্থী দেওয়ার চেষ্টা করব। আমাদের চিন্তা আছে গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্টের ব্যানারে তিন শ আসনে প্রার্থী দেওয়ার। জয়-পরাজয়ের বিষয় নির্বাচন এলে বোঝা যাবে। যদি আমরা পরিস্থিতির পরিবর্তন আনতে পারি তা হলে বিজয় বেশি আসবে। পরিস্থিতি না বদলালে, যা হওয়ার হবে। তবে আমরা চেষ্টা করছি।

