ঢাকা শনিবার, ১৬ আগস্ট, ২০২৫

প্রকৃতির রঙিন ক্যানভাস 

মির্জা হাসান মাহমুদ
প্রকাশিত: আগস্ট ১৬, ২০২৫, ০৫:২৬ এএম

স্বচ্ছ নীল জলের বুক চিরে ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে একটি নৌকা। চারপাশে সবুজ পাহাড়, তার বুক চিরে নেমে আসছে ঝর্ণাধারা, মাথার ওপর নীল আকাশ; সব মিলিয়ে মনে হবে যেন প্রকৃতি নিজ হাতে এঁকে দিয়েছে অপূর্ব চিত্রপট। বাতাসে মিশে আছে পাহাড়ি ফুলের গন্ধ, দূর থেকে ভেসে আসে পাখির ডাক। এমন রঙ, গন্ধ ও সুরের মেলবন্ধনে তৈরি এই ভূস্বর্গের নাম রাঙামাটি। বাংলাদেশের বৃহত্তম জেলা রাঙামাটি শুধু পাহাড়ের শহর নয়, এটি নীল পানি এবং সবুজের বনাঞ্চলের মিলনস্থল। চট্টগ্রাম শহর থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই জেলা সারা বছরই পর্যটকের পদচারণায় মুখর থাকে। ৩-৪ দিনের ভ্রমণে এখানে ঘুরে দেখা যায় অসংখ্য দর্শনীয় স্থান। যার প্রতিটিই নিজস্ব সৌন্দর্যে ভরপুর। চলুন জানি এমন কিছু স্থানের কথা-

কাপ্তাই হ্রদ

রাঙামাটির সৌন্দর্যের মূল কেন্দ্র কাপ্তাই হ্রদ। প্রায় ১১ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই কৃত্রিম হ্রদ চারপাশের পাহাড়, আঁকাবাঁকা পানিপথের মাধ্যমে সেজে উঠেছে। বর্ষাকাল এবং এর আশপাশের সময়ে লেকের পাশের ঝর্ণাগুলো পূর্ণতা পায়, তাই এ সময় নৌকা ভ্রমণের মজা বেড়ে যায় বহুগুণে। ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে লেকের তীর ঘেঁষে ভেসে চলতে চলতে দেখা মিলবে অসংখ্য দ্বীপ, পাহাড়ি গ্রাম। নীল জলের মাঝে দেখা মিলবে অদ্ভুত সব দৃশ্যের।

নির্বাণ নগর বৌদ্ধ মন্দির

কাপ্তাই হ্রদের মাঝখানে একটি ছোট দ্বীপে নিরবে দাঁড়িয়ে আছে নির্বাণ নগর বন বিহার। মাঝখানে স্থাপিত ২৯ ফুট ৮ ইঞ্চি উচ্চতার গৌতম বুদ্ধের মূর্তিটি যেন নীরবে পাহারা দিচ্ছে চারপাশের জলরাশি। নৌকায় চড়ে শুভলং যাওয়ার পথে চোখে পড়বে এই মনোমুগ্ধকর স্থান, যেখানে নীরবতা আর শান্তি একাকার হয়ে যায়।

শুভলং ঝর্ণা

শুভলং ঝর্ণা রাঙামাটির বরকল উপজেলার অন্যতম আকর্ষণ। এখানে প্রায় ৩০০ ফুট উচ্চতা থেকে সশব্দে নেমে আসে জলধারা, যা দেখে মনে হয় পাহাড় যেন কেঁদে চলেছে। এখানে স্থলপথে যাওয়া যায় না; কাপ্তাই হ্রদ পেরিয়েই পৌঁছাতে হয়। কাছেই কালিট্যাং তুগ, এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ, যেখান থেকে রাঙামাটি শহর, কাপ্তাই লেক এবং ভারতের মিজোরামের পাহাড় দেখা যায়। এখানে দাঁড়ালে একসঙ্গে তিনটি দেশের সৌন্দর্য মিশে যায় দৃষ্টির ক্যানভাসে।

ধুপপানি ঝর্ণা

রাঙামাটির বিলাইছড়ি উপজেলার ওড়াছড়ি এলাকায় অবস্থিত ধুপপানি ঝর্ণা যেন প্রকৃতির কোলে লুকানো এক রতœ। প্রায় ১৫০ ফুট উচ্চতা থেকে সাদা পানি আছড়ে পড়ে নিচের পাথরে। বলা হয়, ২ কিলোমিটার দূর থেকে সাদা পানির এই ঝর্ণার ঝিরঝির শব্দ শুনতে পাওয়া যায়। মজার বিষয় হলো- এখানে কথা বলা বারণ। এই ঝর্ণার পাদদেশে সাধুর আশ্রমে ধ্যানমগ্ন থাকেন একজন সাধু। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয়, ‘ভান্তে’। স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন, শব্দে ধ্যানরত সাধুর ধ্যান ভেঙে যাবে। এখানে পৌঁছাতে প্রায় আড়াই ঘণ্টার দুর্গম পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে গন্তব্যে পৌঁছে ঝর্ণার সৌন্দর্য দেখে পথের কষ্ট যেন মুহূর্তেই উড়ে যায়।

ফুরোমন পাহাড়

চাকমা ভাষায় ফুরোমন অর্থ ‘ফুরফুরে মন’। রাঙামাটি শহরের কাছেই অবস্থিত এই পাহাড়ের উচ্চতা ১ হাজার ৫১৮ ফুট। চূড়ায় দাঁড়ালে মনে হয় আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে মাথা। চোখের সামনে কাপ্তাই লেকের নীল জল, চারপাশে সবুজ পাহাড় আর অনন্ত আকাশ মিলে মনে হয় যেন স্বর্গ নেমে এসেছে পৃথিবীতে। তবে ট্রেকিং পথ বেশ দুর্গম, তাই সতর্ক থাকা জরুরি।

ঝুলন্ত সেতু

১৯৮৬ সালে নির্মিত এই ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতুটি এখন ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’ নামে পরিচিত। সেতুর ওপর দাঁড়ালে দেখা যায় হ্রদের বিস্তৃত জলরাশি ও পাহাড়ি প্রান্তর। সন্ধ্যায় যখন লেকের পানি সোনালি আভায় রঙিন হয়ে ওঠে, তখন এই সেতুর সৌন্দর্য দ্বিগুণ হয়ে যায়।

রাজবন বিহার

বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান বৌদ্ধবিহার ‘রাজবন বিহার’ প্রায় ৩৩.৫ একর জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এখানে রয়েছে চারটি মন্দির, ভিক্ষুদের ভাবনা কেন্দ্র, বিশ্রামাগার ও হাসপাতাল। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান। পর্যটকদের কাছে শান্তি ও ইতিহাসের অনন্য সমন্বয়।

পলওয়েল পার্ক

কাপ্তাই হ্রদের পাড়ে জেলা পুলিশের তত্ত্বাবধানে গড়ে ওঠা পলওয়েল পার্ক প্রকৃতি ও আধুনিক নকশার সমন্বয়। এখানে ‘লাভ পয়েন্ট’ বিশেষভাবে জনপ্রিয়; যেখানে প্রেমিক যুগলরা তালা ঝুলিয়ে ভালোবাসার বন্ধনকে স্মরণীয় করে রাখেন। বিশাল চরকির ভেতরে তালা লাগিয়ে চাবি হ্রদে ফেলে দেওয়ার রীতি অনেকের কাছেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে।

টিপস

  • রাঙামাটি ভ্রমণের সেরা সময় বর্ষা ও তার পরের কয়েক মাস।
  • কাপ্তাই হ্রদে নৌকা ভাড়া করে একদিনেই কয়েকটি দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখা যায়।
  • পাহাড়ি পথে চলার সময় আরামদায়ক জুতা ও হালকা পোশাক পরা ভালো।
  • স্থানীয় পাহাড়ি খাবার চোখে দেখা ভ্রমণকে আরও রঙিন করে তুলবে।
  • স্থানীয়দের সঙ্গে ভদ্র ব্যবহার বজায় রাখুন।
  • পরিবেশ এবং প্রকৃতির ক্ষতি হয়, এমন কাজ থেকে বিরত থাকুন।